ঢাকা: প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের সময় প্রকল্পের মোড়কে বিপুল অর্থ লুটপাট করা হয়েছে।
সোমবার মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বিশাল বিশাল প্রকল্প নেয়া হয়েছে ঋণের টাকায়। এসব প্রকল্পের মোড়কে বিপুল অর্থ লুটপাট করেছে। প্রকৃত ব্যয়ের চাইতে কত বেশি ব্যয় ধরে কাদের হাতে টাকাটা পাচার করে দেওয়া হয়েছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে তা তুলে ধরেছে।'
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বৈরাচার সরকারের আমলের লুটপাটের চিত্র তুলে ধরতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি নিয়োগ করা হয় উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই কমিটির কাজ ছিল অভ্যুত্থানের পর অর্থনীতি কোন পরিস্থিতিতে যাত্রা শুরু করলো তার একটা দলিল রচনা করা। এতে কী পেলাম, কী পেলাম না, তার একটা চিত্র তুলে ধরার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এই কমিটিকে। ড. দেবপ্রিয়ের সভাপতিত্বে গঠিত ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি নির্ধারিত সময়ে এই কঠিন কাজ সম্পন্ন করে আমাদের কাছে ৪০০ পৃষ্ঠার একটা বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করেছে।
তিনি বলেন, শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে যে বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক টাকাই লুটপাট হয়েছে। দেশে এমন ধরনের পোষ্যতোষী পুঁজিবাদ তৈরি করা হয়েছিল যার সুবিধাভোগী ছিল স্বৈরাচার ও তার সহযোগীরা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে যে পরিমাণ কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, সেটা অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে দেশের শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ, স্বাস্থ্য বাজেট তিনগুণ করা সম্ভব ছিল।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এই রিপোর্ট পড়ে সকলে অবিশ্বাস্য চোখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। কারো মুখে কথা বের হচ্ছে না। দিন-দুপুরে সকলের সামনে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে পাচার করে নিয়ে গেছে। কেউ বলার ছিল না। কেউ দেখার ছিল না। যারা নিয়ে গেছে তাদেরকে কেউ বাধা দেয়নি। বরং সর্বস্তরে সবাই আগ্রহ সহকারে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। কারণ তারা সব আপন লোক।
পাচার করা টাকা দেশের মানুষের টাকা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘পাচার করা এই টাকা আপনাদেরই টাকা। তারা প্রকাশ্যে আপনাদের কষ্টার্জিত অর্থ লুট করে বিদেশে ভোগ বিলাসে ব্যয় করেছে। সম্প্রতি গার্ডিয়ান পত্রিকাতেও পাচার করা টাকায় গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড় নিয়ে একটা সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। পাচার করা এই সীমাহীন অর্থ এখন আবার দেশে গোলযোগ সৃষ্টি করে তারা এদেশে ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টির কাজে ব্যয় করছে। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন এটাকা কীভাবে দেশের সংহতির বিরুদ্ধে সকল প্রকার অপপ্রচারের কাজে লাগানো হচ্ছে।'
তিনি বলেন, প্রতিবছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে হার দেখানো হয়েছে সেটাও মনগড়া। দেশকে এবং পৃথিবীকে বলা হচ্ছিল কী সুন্দর দেশ বাংলাদেশ! লাফিয়ে লাফিয়ে তার উন্নয়ন এগিয়ে চলছে!
সরকার পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় কাজ হলো পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা। তারা তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে সেটা চেষ্টা করছে। কাজটা কঠিন, কারণ এ বিষয়ক আইন কঠিন। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে সাহস ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। বারবার বলছি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আংশিক টাকা হলেও যেন ফেরত আনা যায়।'
তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংকসহ অন্যান্য সকল দাতা প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে আমাদের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সক্ষম হয়েছে। তারা নতুন উদ্যোগে এবং নতুন উৎসাহে আমাদের সঙ্গে নতুন আর্থিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে এগিয়ে এসছে। অর্থনীতির সাফল্যের ব্যাপারে দেশে এবং বিদেশে আস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে অর্থনীতি তখন ভেঙে পড়ার অবস্থায়। গত চার মাসে এই অবস্থার বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা এবং নিয়ম শৃঙ্খলা ফিরে আসছে। কোনো ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হয়নি। ব্যাংক যতই দুর্বলই হোক তাকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রথমদিকে আমানতকারীর টাকা উত্তোলনের ব্যাপারে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। এখন সেটা তুলে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সকল ব্যাংককে আমানতকারীর আমানত ফেরত দেবার জন্য নতুন টাকার সরবরাহ দিতে প্রস্তুত হয়েছে। আশা করি এতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সকলের আস্থা ফিরে আসবে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট পড়ে দেশের মানুষ হতভম্ব হয়ে গেছে। দেশে বিদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি গভীর আগ্রহ নিয়ে এই রিপোর্টটি সংগ্রহ করছে। দেশের মধ্যে পত্র-পত্রিকা, সেমিনার, আলোচনা সভা, টেলিভিশনে এই নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। ফ্যাসিবাদী সরকার দেশের অর্থনীতিকে ভেঙে দিয়ে গেছে এটা সবাই বুঝতে পারছিল। কিন্তু অর্থনীতিকে কী পরিমাণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিয়ে গেছে তার পরিমাপ সম্বন্ধে কোনো ধারণা করতে পারছিল না। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি হিসাব-নিকাশ করে এর পরিমাণ বের করে দিয়েছে।