কয়েকদিন আগে ভারতের কয়েকজন সাংবাদিক ঢাকা সফরে এসেছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকা দিল্রি ব্যুরো চিফ অগ্নি রায়।
বাংলাদেশ নিয়ে তার একটি প্রতিবেদন আজ পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়েছে। অগ্নি রায়ের প্রতিবেদনটি এখানে তুলে ধরা হলো।
শহরের বাতাসে বারুদগন্ধ। দেওয়ালে আঁকা ইতিহাসের গর্জন। রাস্তার চিরাচরিত ভিড়ের মুখে উদ্বেগ। কাঁচাবাজারে আগুন। চোরা আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা রিং টোনের মতো বেজে চলেছে এই শহর তথা বাংলাদেশের গলি, বিমানবন্দর, মেট্রো স্টেশন, কাফে, সংবাদপত্রের দফতর, রিকশার জটলায়।
হিংসার যে সাম্প্রতিক দৃশ্যকথন শুনে এই সফরে আসা, তাতে নয়াদিল্লি থেকে ঢাকাগামী বিমানে ওঠার সময় উদ্বেগ ছিল না বললে অসত্য হয়! তবে বুক প্রথমেই ছ্যাঁৎ করে উঠল টারম্যাক থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরের দিকে এগোতে গিয়ে। এ কোন কনভেয়র বেল্ট, যেখান থেকে কিছু মাস আগেও সুটকেস পেতে নাকাল হতে হতো ভিড়ের চাপে? কেমনই বা হাল বাইরের ব্যাঙ্ক কাউন্টার আর মোবাইলের সিম কার্ড বদলে নেওয়ার কাউন্টারগুলি, যেখানে দীর্ঘ লাইনে ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটত হামেশাই! এয়ার ইন্ডিয়া-র যে বিমানে এসেছি, নির্ধারিত পিছনের রো থেকে আসন বদলে অনায়াসে প্রথমে আসা গিয়েছে, কারণ ফাঁকা উড়ান। গোটা নির্গমন পথটাই ধূ-ধূ করছে যেন! তেমনই গর্জন করছে বাইরের ঢাকা শহরের দেওয়ালচিত্র। ‘চলুক সংস্কার, চিন্তা হোক স্বাধীন’। ‘পনেরো বছর পর বাংলায় স্বাধীনতা। মানুষ আজ মুক্ত! আনন্দের দিন’। ‘দড়ি ধরেমারো টান...’।
শহরের অন্য কোথাও না থাকলেও মস্কোর রেড স্কোয়ারে অন্তিম শয়নে রয়েছেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, লাইন দিয়ে দর্শনার্থীরা আজও দেখতে যান তাকে। কিন্তু যে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এবং তার কন্যা শেখ হাসিনার ছবিকে সাক্ষী না রেখে একটি শালিক, চড়ুইও উড়ত না, আজ তা অতীতের হিমঘরে। শেখ মুজিব সর্বত্র অন্তর্হিত। হাসিনার প্রাণদণ্ডের দাবি দেওয়াল লিখনে।
অভ্যুত্থান এবং পরিবর্তনের পরে এ এক অন্য বাংলাদেশ, যা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের গোধুলি পোহাচ্ছে। যার আগে কী হয়েছিল তার বেশির ভাগই সবার চোখের সামনে ঘটেছে। কিন্তু আগামী দিনে কী হবে, তা অনিশ্চিত। চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেশের ভাবীকাল, যেখানে আপাতত রাজনৈতিক ভরশূন্যতা বা ভ্যাকুয়াম। যেখানে এত দিন ‘অনাহারে’ থাকা বিভিন্ন পক্ষ, নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য সক্রিয়, চলছে পরস্পরবিরোধী ভাষ্যের কাটাকুটি খেলা। সর্বোপরি যেখানে আকাশ অংশত মেঘলা, আরও একটি ঝড়ের আশঙ্কায় পশ্চিম দিগন্তের মেঘ লালচে। যেমন বিভিন্ন ভাষ্য, সংখ্যালঘু তথা হিন্দু নিপীড়ন নিয়ে। জামায়াতে ইসলামী বলছে, সমস্যাটা ‘সাম্প্রদায়িক’ নয় ‘রাজনৈতিক’। ব্যাখ্যা, মানুষের ক্ষোভ ছিল আওয়ামী লীগের দীর্ঘ অত্যাচার, অবিচার নিয়ে। তাই যেটুকু ক্ষোভ দেখানো হয়েছে বা হচ্ছে তা ওই দলের নেতাদের উপর। ঘটনাচক্রে হিন্দুদের অধিকাংশই আওয়ামী সমর্থক। তাই আঁচ তাদের উপরেও পড়েছে। আবার ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারপন্থী হিন্দু নেতা তথা বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন কমিটির সভাপতি বাসুদেব ধর বা বাংলাদেশে আরএসএস-ঘনিষ্ঠ মুখ গোবিন্দচন্দ্র প্রামাণিকদের দাবি, আওয়ামী লীগের সময়ে দুর্গাপূজায় অনেক বেশি হিংসা ঘটেছে। হিন্দু নিপীড়ন ছিল মাত্রাছাড়া। এখন নাকি তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। অনেকটাই লাগামের মধ্যে চলে এসেছে সম্প্রীতির পরিবেশ। ভারতের কাছে ‘ভুল ভাষ্য’ যাচ্ছে, তাই আস্থার অভাব ঘটছে।
বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দচন্দ্রের বক্তব্য, “আপনাদের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিস থেকে আমার কাছে এখানকার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশদে জানতে চেয়েছিল। আমি একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছি। মাঝে বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারী এই নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলেন অমিত শাহের কাছে। তাকে কিন্তু এই নিয়ে বেশি কথা বলতে বারণ করে দেওয়া হয়েছে বলে আমার কাছে খবর। আসলে যতটা ঘটেছে তার থেকে গুজব রটেছে বেশি। এ কথা আমি ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে জানিয়েছি।”
পাশাপাশি বাসুদেব ধরের বক্তব্য, “গত ৫৩ বছরে সংখ্যালঘুদের উপর অনেক অত্যাচার হয়েছে। এই প্রথম দেখলাম মুহাম্মদ ইউনূস সরকার বিচারের ব্যবস্থা করছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হয়েছে। দুর্গাপূজায় ৩ দিনের ছুটির জন্য আমরা ৩০ বছর আন্দোলন করছি। এ বার আমাদের ইউনূস সরকার ডেকে কথা বলেছে। এই প্রথম দু’দিন ছুটিও ঘোষণা করেছে। হিন্দুদের ৯০ শতাংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত। লীগ এখন পরাজিতপক্ষ। স্বাভাবিক ভাবেই তারা ভয়ে রয়েছে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের ঘনিষ্ঠ হিন্দু নেতারা এভাবেই বিভিন্ন তথ্য ও পরিসংখ্যান তুলে দেখাচ্ছেন, গত ১৫ বছরে দুর্গাপূজার সময়ে এবং তার বাইরেও কী ভাবে হিন্দু মন্দির ও পূজা মণ্ডপ আক্রমণ করা হয়েছে। এই হিন্দু নেতাদের পাশে নিয়েই ইউনূসের প্রেসসচিব শফিকুল আলম দাবি করছেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বড় ধর্মনিরপেক্ষ সরকার আসেনি। কারণ রাজনৈতিক সরকারের একটাই উদ্দেশ্য, তারা ধর্মের তাস খেলতে চায়।” অন্তর্বর্তী সরকার সূত্র এ কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছে, ভারতে যে সরকার চলছে তার কেন্দ্রে রয়েছে হিন্দুত্ববাদ। ফলে বার বার প্রতিবেশী রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু (হিন্দু) নিপীড়নের ভাষ্য তুলে ধরলে, নিজের দেশেও এক ধরনের রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া যায়, বা হিন্দুমনকে একজোট করতে সুবিধা হয়। সেটাই করছে মোদী সরকার। সফরকারী ভারতীয় সাংবাদিককে এ কথাও বলা হচ্ছে, “অনেকেরই ধারণা বাংলাদেশে যে পরিবর্তন এসেছে, তাতে কট্টর ইসলামপন্থীদের ভূমিকা রয়েছে। এই বয়ান একেবারেই ঠিক নয়। ছাত্র এবং সাধারণ নাগরিকেরা এই পরিবর্তন এনেছেন। আওয়ামী লীগ ভয় দেখাত, তারা সরকার থেকে চলে গেলে দেশে ৫ লাখ লোক মারা যাবেন। কিন্তু ৭ দিন টানা পুলিশ ছিল না। একটিও বড় দাঙ্গা হয়নি দেশে।”
সদ্য নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন, ছাত্রলীগের ঢাকার এক নেতা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানালেন ভিন্ন ভাষ্য। তার কথায়, “এবারে বাংলাদেশে দু’থেকে তিন হাজার কম পূজা হয়েছে নিরাপত্তা না-থাকার আশঙ্কায়। প্রকাশ্যে মৌলবাদী মিছিল হয়েছে। বগুড়ায় হিন্দুদের বাড়ির পর বাড়ি পোড়ানো হয়েছে। প্রতিনিয়ত মামলা ছাড়া গ্রেফতারের আশঙ্কা এখন যেমন আওয়ামী লীগ নেতাদের, তেমনই হিন্দুদের মধ্যেও।”