এই লেখা যখন লিখছি, তখনও জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিহতদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ চলছে। ক্রমে বাড়ছে সংখ্যা। এত অল্প সময়ে এত বিপুল মানুষ হত্যার নজির স্বৈরশাসনের বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। কান পাতলে এখনও ঘরে ঘরে কান্নার রোল শুনতে হয়। অনেক আহত এখনও হাসপাতালে কাতরাচ্ছে।
এখন পর্যন্ত ৭৫৯ জন শহীদের তথ্য দেখেছি। তাতে ১০০ জনের বেশি শ্রমজীবী। গণঅভ্যুত্থানে শ্রমজীবী মানুষের এত বিপুল অংশগ্রহণ ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের ১৮৭১ সালের 'প্যারি কমিউনে'র কথা মনে করিয়ে দেয়। কোনো জনপদের মানুষ যে 'একসঙ্গে লড়তে, একসঙ্গে বিজয়ী হতে এবং একসঙ্গে গান গাইতে' পারে, ফরাসি দেশের ওই অভ্যুত্থান সেটা প্রমাণ করেছিল। বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানও ঠিক সেরকম কিছু। কিংবা আরও বেশি কিছু। যাকে বিশ্বব্যাপী এখন 'বাংলা-বসন্ত' বলা হচ্ছে। যে বসন্তের গ্রাফিতিতে ঢাকার দেয়ালগুলো বর্ণিল হয়ে আছে।
যে কারণে বাংলা-বসন্ত বিশ্বে গুরুত্ব পাচ্ছে
বাংলা-বসন্তের আগে বিশ্বে ধারণা তৈরি হয়েছিল, 'সার্ভিলেন্স-স্টেট'র যুগে রূপান্তরবাদী রাজনীতি বিজয়ী হতে পারবে না। বলা হচ্ছিলো, এটা গোয়েন্দাদের যুগ, প্রতিক্রিয়াশীলদের যুগ, পপুলিজমের যুগ এবং এটা পেগাসাসের দাপটের কাল। কিন্তু জর্জ অরওয়েল বেঁচে থাকলে অবাক হয়ে দেখতেন, বাংলাদেশের মানুষ '১৯৮৪' কে ২০২৪ এ উল্টে দিয়েছে। এই গণঅভ্যুত্থান তাই বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত জাতিগুলোর মাঝে নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে। তারা ভাবছে 'বিজয় সম্ভব'। ফলে বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থানকে রক্ষা করতে পারার বৈশ্বিক প্রয়োজন আছে। আবার একে ব্যর্থ করার রক্ষণশীল বৈশ্বিক প্রচেষ্টাও অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে কিছু কিছু ভারতীয় রাজনৈতিক ভাষ্যকারের বয়ানে ওইরকম প্রবণতা আছে।
সিভিল প্রশাসনের ঢিলেঢালা ভঙ্গী
ইতোমধ্যে বাংলা-বসন্ত দেশের ভেতরেই বেশকিছু বিপদে পড়েছে। অভ্যুত্থানের পর যে সরকার গঠিত হয়েছে, তার সবলতা নিয়ে সমাজে সন্দেহ ছড়িয়েছে। দক্ষতা ও শক্তির ইমেজ সংকটে পড়ে আছে সরকার।
হয়তো তারই পার্শ্বফল হিসেবে প্রশাসনকে প্রত্যাশিত মাত্রায় সচল দেখা যাচ্ছে না। 'থানা'গুলোর কাজকর্ম পুরোদমে চালু হয়নি এখনও। টহল আগের মতো নেই। চুরি-ছিনতাইয়ের নজির বাড়ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় শিল্প-কারখানায় আগুন দেওয়ার ঘটনা।
গাজী টায়ার ও প্রাণ-আরএফএলের কারখানায় আগুনের ঘটনা শিল্পপতিদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। গাজী টায়ারে দীর্ঘসময় ধরে লুটপাট হলো-তারপর আগুণ লাগলো, অথচ প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা দেখা গেল না। ব্যাপারটা উদ্বেগজনক। বিস্ময়কর।
আগুন ও আতঙ্কে পড়ে শিল্পপতিদের যে বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তা চেয়ে বেড়াতে হচ্ছে, সেটাও নিশ্চয়ই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য বিব্রতকর খবর। বিভিন্ন মহলে শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের এরকম দেখা-সাক্ষাতের টিভি-সংবাদ মানুষের মাঝে অভ্যুত্থানপরবর্তী সরকারের শক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দেয়।
একই সময় ঘোষণা দিয়ে বিভিন্ন স্থানে মাজার ভাঙচুর গ্রামীণ সমাজে ভয় ছড়িয়েছে। প্রশাসনের কেউ তাৎক্ষণিকভাবে এসব থামানোকে কর্তব্য মনে করছে না।
এমনকি বৃহত্তর নোয়াখালীতে ভয়াবহ বন্যার মাঝে সিভিল প্রশাসন সমন্বয়কের নেতৃত্বদায়ী ভূমিকাও নিতে পারেনি। মানুষকে বরং ভরসা করতে হচ্ছে সেনাবাহিনী ও শিক্ষার্থীদের উপর। ঢাকা থেকে ত্রাণের শত শত ট্রাক গেলেও প্রান্তিক এলাকার কোথায় ত্রাণ যাওয়া জরুরি, সেরকম নির্দেশনায় প্রবল দুর্বলতা দেখা গেছে।
বড় রাস্তার আশেপাশে কোথাও ত্রাণ দিয়ে ছবি তুলে চলে আসছে মানুষ। ত্রাণ দেওয়া ও ভারতকে দোষারোপ করা ছাড়া বন্যার পানি সরাতে কারো যেন কিছু করার নেই। জলাবদ্ধতায় অচিন্তনীয় এক দুর্দশায় আছে বৃহত্তর নোয়াখালীর মানুষ।
মানুষ ভরসা হারাতে চাইছে না
নোয়াখালীর মতোই অন্যান্য বন্যাহীন জেলাতেও সিভিল প্রশাসনে গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট প্রায় অনুপস্থিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের দপ্তরে-দপ্তরে এতদিনকার কর্তাদের তাড়িয়ে নতুনদের বসার সার্কাসই কেবল চোখে পড়ছে।
কেন 'পুরানো'দের সরতে হবে এবং কোন ধরনের 'নতুন'দের আসা জরুরি, তার কোনো রাজনৈতিক-দার্শনিক নির্দেশনা যায়নি মাঠপর্যায়ে।
ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল হাজিরা আর গোষ্ঠীগত দখল-বেদখলের চক্করে পড়ে গেছে। মানুষ নিত্যদিনের 'সার্ভিস' পেতে যেয়ে 'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে'র কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।
'যুদ্ধ' শেষে নতুন দেশ নির্মাণে তাদের অংশগ্রহণের জায়গা কোথায় সেটাও বুঝতে পারছে না মানুষ। অর্থাৎ গণঅভ্যুত্থানের এত বড় ঘটনার পরও কেন্দ্র থেকে কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক 'ভিশন' জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যায়নি। উদ্দীপনা ও অঙ্গীকারের সবকিছু যেন আটকে আছে টিভির পর্দায়। সবার অজান্তে হতাশার বীজ পড়ছে জমিনে। যে জমিনে এখনও রক্তের দাগ শুকায়নি। তবে সাধারণ মানুষ এখনও হতাশ হতে প্রস্তুত নয়। অন্তত মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে তাদের বিস্তর ভরসা।
মন্ত্রিত্ব নয়, শিক্ষার্থীরা চাইছে সামাজিক কাজের আহ্বান
আশা ও হতাশার চলতি টানাপোড়েনের মাঝে সমাজের সঙ্গে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সমন্বয়ের কাজটি করতে পারতো গণঅভ্যুত্থানের 'ছাত্র-জনতা'। কিন্তু জেলায় জেলায় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান কমিটি গঠনের কাজটি হয়নি। দেশ গঠনের সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচিও তাদের ধরিয়ে দেওয়া হয়নি। চাইলে এখনও এই ছাত্র-জনতাকে দিয়ে বহু ধরনের দেশগঠনমূলক কাজ করিয়ে নেওয়া যায়।
মাঠপর্যায়ে অনেককে বলতে শুনেছি, অবৈধভাবে দখল করা নদীসম্পদ উদ্ধার থেকে শুরু করে বহু ধরনের জাতীয় এজেন্ডা ছাত্রসমাজ সামান্য সময়ে সমাধান করে দিতে পারতো।
প্রশাসনহীন প্রথম কয়েকদিন দেশজুড়ে ট্রাফিক কাজ সামাল দিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছিল, যেকোনো ব্যবহারিক কারিগরি কাজ করে দিতে সম্মিলিতভাবে তারা প্রস্তুত। বন্যার ত্রাণেও তারা সেরকম আরেক নজির রেখেছে। 'বুড়ো-সমাজ' তখন তাদের দুহাত ভরেই সহযোগিতা করেছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা বন্যা-উত্তর কৃষি পুনর্বাসনের জন্য স্ব-উদ্যোগে চারা উৎপাদনের কাজে নেমেছে। অনেকের হয়তো মনে আছে, ১৯৭২-৭৩ এ এরকম আগুন আরেকবার জ্বলে উঠেছিল বাংলার সমাজে। কিন্তু নতুন সরকার সেই আগুনের সলতে জ্বালিয়ে রাখতে স্বতস্ফূর্ত তরুণ বাহিনীকে তেমন কোনো কাজ দিতে পারছে না। বরং শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশিত 'সম্মিলিত-জাতীয়-ভূমিকা'র বদলে গুটিকয়েক ছাত্রনেতাকে 'উপদেষ্টা' হতে দেখছি আমরা। এরকম আরও কিছু সংখ্যক হয়তো আমলাতান্ত্রিক কাজকর্মে যুক্ত হবেন।
এসবের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হতে পারে পুরানো আমলাতন্ত্রের সঙ্গে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার 'সমন্বয়'। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের দাবি ছিল উপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় নয়—ওই আমলাতন্ত্রের ভেতর ছাত্র-জনতার অভিষেকও নয়, তার আমূল সংস্কার। তার আপাদমস্তক বদল। সমন্বয়বাদী সাংগঠনিক কৌশলের বিপজ্জনক ফল হতে পারে দুটো: প্রতিভাবান ও সম্ভাবনায় ভরপুর ছাত্র সংগঠকদের আমলাকরণ এবং নিয়োগ-বদলি-বরখাস্তে তাদের মূল্যবান সময়ের অপচয় ঘটানো। দ্বিতীয়ত, 'সমন্বয়ক'দের এসব কাজে দেখে পুরো 'জেনারেশন-জেডে'র মাঝে হতাশা তৈরি হতে পারে।
দুটো অবস্থাই হবে চরম আত্মঘাতি। 'বসন্ত'কে জোর করে 'শীতে' রূপান্তর করার মতো।
যে অভ্যুত্থান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল, সেটা নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন ছাড়া পুরোপুরি অসমাপ্ত রয়েছে। ফলে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের পুরো দলকে আরও দীর্ঘ সময় মাঠে থাকা জরুরি ছিল। তাদের উচিত ছিল সংস্কারের মেঠো চাহিদাগুলোকে তুলে আনা। সেসব সমন্বয় করে ক্রমাগত সরকারের সামনে হাজির করা। কেবল এই পথে মাঠপর্যায়ে পরাজিত শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো না এবং অভ্যুত্থান একটা চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে জীবন্ত থাকতো। বেসামরিক প্রশাসনও তখন এখনকার মতো নিষ্ক্রীয় হয়ে বসে থাকার স্যাবোটাজ করতে পারতো না।
কিন্তু উল্টো বরং কিছু বিপজ্জনক শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও শোভেনিজমের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে কিছু তরুণকে 'গণ'আন্দোলনের স্বত্ব ধরিয়ে দেওয়ার প্রচার-প্রচারণা আছে মাঠে। কাউকে কাউকে আদর করে 'মাস্টার-মাইন্ড' বলে তকমা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তিবাদের বুদবুদ সরালে আমরা দেখতে পেতাম, বাংলা-বসন্তের 'মাস্টার-মাইন্ড' হলো গণতন্ত্রের সর্বগ্রাসী এক আকাঙ্ক্ষা মাত্র। ছাত্র-জনতা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে 'এক দফা'র আন্দোলনে পরিণত করেছিল 'সমন্বয়ক'দের একদিন আগেই। এটা যেন আমরা ভুলে না যাই।
আন্দোলনের অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র বাড়ানো দরকার
জুলাই-আগস্টের আন্দোলন যেমন কোনো ব্যক্তিনেতা বা দল বা জোটের নেতৃত্বে হয়নি, তেমনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ কর্তৃক এই আন্দোলনের একক কর্তৃত্বের দাবিও অসঙ্গত। এমনকি এই আন্দোলন অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো জোটেরও একক কিছু নয়।
নিহত-আহত মানুষদের পেশাগত ও ভৌগলিক বিবরণ জানিয়ে দিচ্ছে, এই আন্দোলন দেশের সব শ্রেণীপেশার মানুষের সংগ্রাম। এমনকি এই আন্দোলন কোটা সংস্কার প্রশ্নে শুরু হয়েছে এবং শেখ হাসিনার ভারত চলে যাওয়ার মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে ভাবাও ঐতিহাসিকভাবে ভুল।
বহু শ্রেণীপেশার মানুষের গত ১৪-১৫ বছরের লড়াই-সংগ্রামের নির্যাস যুক্ত হয়ে আছে বাংলা-বসন্তে। সুতরাং এটা কেবল জুলাই মাসের কোনো মধ্যবিত্ত-নবজাতক নয়। এত দীর্ঘ সময়ের অনেক মানুষের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ছাড়া এই আন্দোলন থামবেও না। সেই অর্থে শুধু একটা সুষ্ঠু নির্বাচন এই আন্দোলনে নিহত-আহত শ্রমজীবীদের সন্তুষ্ট করতে পারবে না।
জুলাই-আগস্টে সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মরেছে যে স্পটে সেই যাত্রাবাড়ীতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। এটা প্রধানত শ্রমজীবী মানুষের এলাকা। এখানে 'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে' সবচেয়ে রক্তাক্ত প্রতিরোধ হয়।
এরকম মানুষদের জীবনদান কেবল কোটাপ্রশ্নে হয়নি। নিজেদের জীবনধারার দীর্ঘদিনের বিবিধ সংকট তাদের রাস্তায় নামিয়েছিল। সর্বগ্রাসী চাঁদা আর অনেকগুলো নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার অপমানও তারা ভুলতে পারছিল না।
ফলে এসব শ্রেণীপেশার মানুষ যে এখন তাদের পেশাগত দাবি দাওয়া নিয়ে সরকারের সামনে হাজির হবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। ওষুধ কোম্পানির শ্রমিক থেকে শুরু করে রিকশাচালকরা যে মিছিল-মিটিং করছে, তার সবই একটা জীবন্ত সমাজের পুনর্জন্মের লক্ষণ। আনসার বা ডাক্তার পেটানো ঘটনা হিসেবে তাই খুবই প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের নজির। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এসব বিষয়ে পুনর্ভাবনা দরকার।
অভ্যুত্থানের অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র বাড়াতে হলে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার দাবি-দাওয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে এখন। এই মুহূর্তে কেন ট্রেড ইউনিয়নবাদী দাবি তোলার বদলে রাজনৈতিক সংস্কারের সুযোগ করে দেওয়া জরুরিম সেটা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে যেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠকরা বোঝাতে পারেন। অর্থাৎ, আন্দোলনের শক্তিগুলোকে এখন আমলাতন্ত্রের সঙ্গে সমন্বয়ের বদলে বেশি করে বিভিন্ন প্রান্তিক শ্রেণী-পেশার সঙ্গে সমন্বিত হওয়া দরকার। এরকম বিভিন্ন পেশাজীবীদের দাবি-উত্থানকারীদের লাঠি দিয়ে দৌড়ানো দীর্ঘমেয়াদে বুমেরাং হবে। এখনও যে উপদেষ্টা পরিষদে শ্রমিক-কৃষক কারো প্রতিনিধি নেই এবং তারপরও যে এই সরকারকে যথেষ্ট অন্তর্ভুক্তিমূলক বলে জনগণ মেনে নিচ্ছে, সেটা ছাত্রদের প্রতি দরদ এবং কয়েকজন উপদেষ্টার প্রতি আস্থার কারণে। কিন্তু কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়।
এর মাঝে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় হঠাৎ যে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ কমে গেল, সেটা বেশ চোখে লাগছে। অথচ জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের বড় শক্তিভিত ছিল রাতে-দিনে ছাত্রীদের দীর্ঘ জঙ্গি মিছিল। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে নয়, জেলা-উপজেলায়ও কিশোরীরা তুমুল আবেগ আর উচ্ছ্বাসে এই আন্দোলনে সামনের কাতারে ছিল। বাংলাদেশের নারী সমাজ সম্পর্কে দেশে-বিদেশে গতানুগতিক যেসব ধারণার রাজত্ব ছিল, এবার তার মোটাদাগে অবসান ঘটে গেছে। একটা বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক সমাজই বিগত আন্দোলনের এসব অগ্রসর উপাদানকে ধারণ করতে পারে কেবল। কিন্তু মাঠে কিছু ভিন্ন প্রবণতাও আছে। তার মধ্যে একটা হলো গণঅভ্যুত্থানকে কোনো বিশেষ মতাদর্শের 'বিপ্লবে' রূপান্তর চেষ্টা। ইতোমধ্যে ইসলামী দলগুলো 'বিপ্লবী' লক্ষ্যে একত্রে বসছে বলে প্রচার মাধ্যম জানাচ্ছে। 'নিষিদ্ধ' অনেক সংগঠনের সংগঠকদের মামলা প্রত্যাহারেরও খবর দেখা যাচ্ছে। অনেক 'বুদ্ধিজীবী' বর্তমান সরকারকে 'বিপ্লবী সরকারে' রূপান্তরের জন্য জনমত গঠন করছেন। এভাবে ৩৬ জুলাইয়ের 'ঐক্যবদ্ধ-শক্তি' নানান উপদলে বিভক্ত হচ্ছে। অনেকেই নিজ নিজ মতাদর্শিক আকাঙ্ক্ষাকে অভ্যুত্থানের স্পিরিটের ভেতর ঠেসে দেওয়ার চেষ্টায় আছেন।
অথচ জুলাই-আগস্টে মাঠপর্যায়ে দেখা গিয়েছিল অন্য দৃশ্য। মূলত গণতন্ত্র ছিল সবার মিলিত একক দাবি। গণহত্যাবিরোধী ক্ষোভ ওই মিলিত দাবিকে বিস্ফোরক করে তুলেছিল। মানুষ ঘাতক বন্দুকের সামনে দাড়িয়েছিল কোনো 'বিপ্লবী মতাদর্শে'র নির্দেশে নয়। কোনো বুদ্ধিজীবীর আহ্বানে নয়, শুধু একটা গণতান্ত্রিক সমাজের আকাঙ্ক্ষা থেকে। এক ব্যক্তির সীমাহীন কতৃর্ত্ববাদের বিরুদ্ধে। সমাজে পুলিশী দাপটের বিরুদ্ধে।
'৩৫-৩৬ জুলাই' বাংলাদেশ দেখেছিল সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের ঐক্যবদ্ধ এক গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ। গণতন্ত্রের দাবিই ছিল তখনকার বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা। সেই সূত্রে আজকে অর্থবহ গণতন্ত্র কায়েমই প্রকৃত বিপ্লবী কর্মসূচি। বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে এর চেয়ে বেশি 'বিপ্লবী' চাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত চাপ হিসেবে দেখা দিতে পারে।
তবে বাংলা-বসন্তের মৌলিক প্রত্যাশাগুলো পূরণ করতে রাষ্ট্রের উপনিবেশিক কাঠামোর কিছু মৌলিক সংস্কার লাগবেই। তার মধ্যে আছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের সংস্কার। এসব সংস্কার কর্মসূচি এগিয়ে নিতে সংবিধান পুনর্লিখনও লাগতে পারে। তার জন্য প্রস্তাবিত নির্বাচনকে ১৯৭০-এর মতো গণপরিষদ নির্বাচন আকারে আয়োজনের প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। এর মাঝে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যেমন দ্রুত কিছু সংস্কার করতে হবে তেমনি কিছু সংস্কারের জন্য দরকার হবে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ও সম্মতি। অতি প্রয়োজনীয় সেই অংশগ্রহণ ছাড়া রূপান্তর চিন্তার বাস্তবায়ন কঠিন হবে—তাকে টেকসই করাও দুঃসাধ্য হবে। এক্ষেত্রে মধ্যপন্থী বিএনপিকে বিশেষভাবে সরকারের পাশে এগিয়ে আসা দরকার।
মাঠপর্যায়ে বিএনপি কর্মীদের 'দখল মনোভাবে'র লাগাম টেনে ধরার পাশাপাশি এ দলের নেতৃত্বের প্রধান দায় অবশ্যই সংস্কার উদ্যোগে সরকারকে মদদ দেওয়া।
এ মুহূর্তের বাংলাদেশে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মাঝে বিএনপি নিশ্চিতভাবে প্রধান এক শক্তি। তারা নিজেরা ইতোমধ্যে কিছু সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে। ফলে আন্দোলনের শক্তি হিসেবে অদলীয় 'ছাত্র-জনতা' এবং 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে'র সঙ্গে বিএনপির মতদ্বৈতার জায়গা কম। তবে বিএনপির সংস্কার প্রস্তাবগুলো বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে খুব মৃদু। ইতিবাচক একটা দিক হলো বাংলাদেশে সংস্কারের রাজনীতি অন্যতম প্রবক্তা 'গণতন্ত্র মঞ্চ' বিএনপির মিত্রশক্তি। এই দুইপক্ষ মিলে সংস্কারে আগ্রহী সরকারকে সহযোগিতা করলে নির্বাচন বেশি দেরি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
নির্বাচন অনির্দিষ্ট সময়ের ঝুলে থাকলে মাঠপর্যায়ে উন্নয়ন কাজের গতি ধীর হতে বাধ্য। এ ছাড়া, নির্বাচিত সরকার ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগও সামান্যই আসবে।
উপজেলা থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত শহর-গ্রাম কোনো স্তরে জনপ্রতিনিধি নেই এখন। একদিকে এতদিনকার দলীয়করণের শিকার প্রশাসন চূড়ান্ত টানাপোড়েনে আছে, অন্যদিকে একই কাঠামোর ওপর পড়ছে বাৎসরিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ভার। ফলাফল সহজে অনুমান করা যায়। সুতরাং সংস্কার এবং নির্বাচন দুটোই দ্রুত করতে হবে। তবে সেই ফাঁকে দুর্নীতি ও লুটপাটেরও বিচার হতে হবে।
হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের বিশ্বাসযোগ্য খবরের পরও শিল্পপতি ও রাজনীতিবিদ নামের মাফিয়াদের যদি বিচার ও সাজা না হয়, তাহলে দেশে আন্দোলনের শক্তিগুলোর গণআদালত না বসিয়ে উপায় থাকবে না। দুর্নীতি-গুম-হত্যার সংস্কৃতি বাংলাদেশের অস্তিত্বকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে।
দুর্নীতিকে কাঠামোগতভাবে রুখতে দুদককে চলতি রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সংস্কার করা জরুরি।
সংস্কার এগিয়ে নিতে সংবাদমাধ্যমকে গণমাধ্যমে পুনর্গঠন দরকার
দুর্নীতির স্থানীয় ধরন বুঝতে মিডিয়া জগতের বিরাট দায় রয়েছে এ মুহূর্তে। সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং মিডিয়াকে ব্যবসায়িদের লাঠিয়ালের জায়গা থেকে উদ্ধারের পথ দেখানো এক্ষেত্রে শুরুর চাহিদা। প্রচার মাধ্যমগুলোকে এমন ধরনের ট্রাস্টের অধীনে আনা যায়, যেখানে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সাংবাদিকতাসুলভ নীতিমালা থাকবে।
বিগত বছরগুলোতে প্রচারমাধ্যম একদিকে ক্ষমতাবানদের টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহৃত হয়েছে, অন্যদিকে সাইবার আইনের ভয়ে কেজো সাংবাদিকরাও খুব বেশি কিছু লিখতে-বলতে পারেনি। মামলা-মোকদ্দমা তো ছিলই।
দেশের প্রধান ইংরেজি কাগজের সম্পাদক এই লেখককে তার বিরুদ্ধে ৮০টি মামলার কথা জানিয়েছিলেন। এরকম অবস্থার জেরে থেকে মিডিয়া কীভাবে নতুন দেশ গড়ায় ভূমিকা রাখতে পারে? কিন্তু কোনো কাঠামোগত সুরাহার বদলে এতদিনকার সুবিধাবাদী অনেক মিডিয়া 'হাউস' ২-১ জনকে বরখাস্ত ও নিয়োগ করে লুকোচুরির আশ্রয় নিচ্ছে।
মিডিয়া জগতের মতোই এখনি নজর দেওয়া দরকার বিদেশে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা বন্ধে। এরকম প্রচার বন্ধের একটা কার্যকর পথ হলো, কথিত সহিংস ঘটনাগুলোর বিশ্বাসযোগ্য নিরপেক্ষ তদন্ত এবং ফ্যাক্ট চেকারদের গণব্যবহার। দ্বিতীয় পথ, বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিসত্তার নেতাদের দিয়ে ব্যাপকভিত্তিক কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো। এসব কাজে সরকার ও ছাত্র আন্দোলনকে অবশ্যই যেকোনো দক্ষিণপন্থী স্যাবোটাজকে অঙ্কুরেই নিষ্ক্রিয় করার হিম্মত দেখাতে হবে।
যে বহুত্ববাদী চরিত্র নিয়ে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, বাংলাদেশের ভবিষ্যতও সেভাবে বহুত্ববাদকে বজায় রেখেই গড়তে হবে।