জম্মু ও কাশ্মির এবং হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনের অধিকাংশ বুথফেরত সমীক্ষার পূর্বাভাস দেখে হতাশ বিজেপি। লোকসভা ভোটের পর প্রথম বড় নির্বাচনে দুই বিধানসভাতেই বিজেপির হারের পূর্বাভাস রয়েছে তাতে। তার মধ্যে এক দশক পরে হরিয়ানায় কংগ্রেসের কাছে ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে নরেন্দ্র মোদির দল।
অন্য দিকে, ‘ইন্ডিয়া’র দুই শরিক ন্যাশনাল কনফারেন্স-কংগ্রেস জোট জম্মু ও কাশ্মিরে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে পারে বলে অধিকাংশ বুথফেরত সমীক্ষার পূর্বাভাস। তবে হরিয়ানায় কংগ্রেসে সংখ্য়াগরিষ্ঠতা পেলেও ত্রিশঙ্কু হতে পারে জম্মু ও কাশ্মির। অবশ্য ভারতে ভোটের ইতিহাস বলছে, আসল ফলের সঙ্গে বুথফেরত সমীক্ষা অনেক সময়েই মেলে না। তবে ফলাফল মিলে যাওয়ার উদাহরণও কম নয়। আসল ফল জানতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) গণনার দিন পর্যন্ত। ঘটনাচক্রে, দুই বিধানসভাতেই আসনসংখ্যা ৯০। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জাদু সংখ্যা ৪৬।
হরিয়ানায় অনেক পেছনে বিজেপি
ইন্ডিয়া টুডে-সি ভোটারের বুথফেরত সমীক্ষা অনুযায়ী হরিয়ানায় কংগ্রেসের ৫০-৫৮, বিজেপির ২০-২৮, জেজেপির ০-২ এবং অন্যদের ঝুলিতে ১০-১৪ আসন যেতে পারে। অন্যদের মধ্যে রয়েছে, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমপ্রকাশ চৌটালার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোকদল (আইএনএলডি)। ওই সমীক্ষা বলছে, কংগ্রেস ৪৬ শতাংশ, বিজেপি সাড়ে ৩৬ শতাংশ ভোট পেতে পারে। অর্থাৎ, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের ভোটের ফারাক হতে পারে প্রায় ১০ শতাংশের।
এবিপি নিউজ়ে প্রকাশিত ‘পিপল্স পাল্স’ বুথফেরত সমীক্ষার ফল বলছে হরিয়ানা বিধানসভার ৯০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৪৯-৬১ , বিজেপি ২০-৩২ , প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমপ্রকাশ চৌটালার আইএনএলডি ২-৩, অন্যেরা ৪-৫ আসনে জিততে পারে। ‘অন্যদের’ মধ্যে রয়েছে প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী দুষ্মন্ত চৌটালার জননায়ক জনতা পার্টি (জেজেপি)। নিউজ১৮-এ প্রকাশিত বুথফেরত সমীক্ষা অনুযায়ী হরিয়ানায় কংগ্রেস ৫৪, বিজেপি ২৬, আইএনএলডি ১, জেজেপি ১ এবং অন্যেরা ৮টি আসনে জিততে পারে।
রিপাবলিক-ম্যাট্রিজ বুথ ফেরত সমীক্ষার ফল বলছে, হরিয়ানায় কংগ্রেস ৫৫-৬২, বিজেপি ১৮-২৪, আইএনএলডি ৩-৬, জেজেপি ০-৩ এবং অন্যেরা ২-৫ আসনে জিততে পারে। কংগ্রেস প্রায় ৩৬ শতাংশ, বিজেপি ৩০ শতাংশ, আইএনএলডি ১২ শতাংশ, জেজেপি সাড়ে ৬ শতাংশ এবং অন্যেরা ১৫ শতাংশ ভোট পেতে পারে। ২০১৯ সালের বিধানসভা ভোটে হরিয়ানায় বিজেপি ৪০, কংগ্রেস ৩১, জেজেপি ১০, আইএনএলডি ১ অন্যেরা ৮টি আসনে জিতেছিল।
আগেই হরিয়ানায় জেতার আশা ত্যাগ করেছিল বিজেপি? শেষ লগ্নে এসে প্রচারের যা হালচাল এবং শীর্ষ নেতৃত্বের যে গাছাড়া ভাব তাতে দলের কর্মীরাই রীতিমতো সন্দিহান হয়ে উঠেছিল। ২০১৪ সাল থেকে টানা দশ বছর হরিয়ানায় বিজেপি ক্ষমতায়। এই দশ বছরে রাজ্য রাজনীতিতে এবং মানুষের চিন্তা চেতনায় ভোল বদলের চেষ্টায় কোনো ঘাটতি রাখেনি। গোরক্ষার নামে গেরুয়া গুন্ডাগিরি কম হয়নি। ধারাবাহিকভাবে চালানো হয়েছে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরির প্রয়াস। উত্তর ভারতের গোবলয়ের এই রাজ্যটিতে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও বিভাজন পাকাপোক্ত করে রাজনীতিতে তার স্থায়ী প্রতিফলনের চেষ্টা হয়েছিল। নানাভাবে ব্যবহারের চেষ্টা হয়েছিল ধর্মগুরুদের। কিন্তু তাতে যে চিঁড়ে বিশেষ ভেজেনি এবারের নির্বাচনী প্রচারে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলছে।
যে সিলেবাসকে সামনে রেখে বিজেপি তাদের স্থায়ী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার ছক কষেছিল তাতে সাময়িক উন্মাদনা সৃষ্টি হলেও এবং আপাতদৃষ্টিতে হিন্দুত্ববাদের জয়ডঙ্কা বাজলেও তা স্থায়ী কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। উল্টো এই ভোটের আবহে মানুষের কাছে ভয়াবহ বেকারত্ব, কৃষি ও কৃষকের সঙ্কট, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, অগ্নিবীর প্রকল্প নিয়ে ক্ষোভ, দেশের জন্য পদকজয়ী কুস্তিগিরদের যৌন লাঞ্ছনা ইত্যাদিই প্রধান সিলেবাস হয়ে উঠেছে। হরিয়ানার ছেলে মেয়েরাই বিশ্ব ক্রীড়া মঞ্চে কুস্তি, বক্সি, শ্যুটিং ইত্যাদিতে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করে থাকে। সেই কৃতী মহিলারা যখন দিনের পর দিন বিজেপি সাংসদের যৌন লাঞ্ছনার শিকার হয় তখন দল ও সরকার নীরবতা পালন করে। মোদি সরকারের তিন কুখ্যাত কৃষকবিরোধী আইনের বিরুদ্ধে যখন ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন চলে তখন তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চালায় ডাবল ইঞ্জিনের সরকার। আজও কৃষকরা অনির্দিষ্টকালে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছে শম্ভু সীমান্তে। সেনাবাহিনীতে হরিয়ানার যুবকরা সর্বাধিক হারে যোগ দেয়। এটাই হরিয়ানার যুবকদের কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। মোদি সরকার অগ্নিবীর প্রকল্প চালু করে তাদের সুযোগ কেড়ে নিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে মানুষকে অন্ধ বিজেপি সমর্থক করার চেষ্টা হলেও মানুষ জীবন-জীবিকার অনিশ্চতা ও দুঃসহ যন্ত্রণাকে আশ্রয় করে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। তাই ভোটমুখী হরিয়ানায় শাসকের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ কান পাতলেই শোনা গেছে। এই প্রবল ভাটার টানকে জোয়ারে পরিণত করতে প্রথম দিকে কিছুটা উদ্যোগ নেওয়া হলেও হাল ছেড়ে দেয় বিজেপি। খোদ প্রধানমন্ত্রী যার ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে সব নির্বাচনে বিজেপি জিততে চায়, সেই নরেন্দ্র মোদিই প্রচারে নিরুৎসাহী ছিলেন। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে প্রচারে যথাক্রমে ১০ বার ও ৭ বার মোদি প্রচারে গেলেও এবার মাত্র চার বার গেছেন। তাছাড়া প্রচারে শেষ দু’দিন মোদি-শাহ দু’জনেই গরহাজির ছিলেন।
গত লোকসভা ভোটেই মোদি টের পেয়ে গেছেন তার বহুল প্রচারিত ভাবমূর্তি অকেজো হয়ে গেছে। হরিয়ানার সেটা কোনো কাজে আসবে না। তাই প্রচারে ডাবল ইঞ্জিনের দশ বছরের সাফল্যের কথা বলার সাহস পাননি। বদলে লাগাতার কংগ্রেসকে গাল পেড়েছেন। এমনকি কংগ্রেসকে সাম্প্রদায়িক বলতেও তার মুখে আটকায়নি। কিন্তু এতে কোনো লাভই হয়নি।
জম্মু ও কাশ্মির
ইন্ডিয়া টুডে-সি ভোটারের বুথফেরত সমীক্ষা বলছে, জম্মু ও কাশ্মিরের ৯০টি আসনের মধ্যে এনসি-কংগ্রেস জোট ৪০-৪৮, বিজেপি ২৭-৩২, পিডিপি ৬-১২ এবং অন্যেরা ৬-১১টি আসনে জিততে পারে। অঙ্কের হিসাবে এনসি-কংগ্রেস জোট ৩৯ শতাংশ, বিজেপি ২৩ শতাংশ, পিডিপি ১০ শতাংশ এবং অন্যেরা ২৮ শতাংশ ভোট পেতে পারে।
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মিরের ৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৪৭টি কাশ্মির উপত্যকা এবং ৪৩টি জম্মুতে রয়েছে। ইন্ডিয়া টুডে-সি ভোটারের পূর্বাভাস, জম্মুর ৪৩টি আসনের মধ্যে ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি)-কংগ্রেস জোট ১১-১৫, বিজেপি ২৭-৩১, পিডিপি ০-২ এবং অন্যন্য প্রার্থীরা ০-১টি আসনে জিততে পারেন। কাশ্মির উপত্যকার ৪৭টি আসনের মধ্যে এনসি-কংগ্রেস জোট ২৯-৩৩, পিডিপি ৬-১০, বিজেপি ০-১ এবং অন্যেরা ৬-১০টি আসন পেতে পারে।
রিপাবলিক-গুলিস্তান নিউজ বুথ ফেরত সমীক্ষার পূর্বাভাস, জম্মু ও কাশ্মির ত্রিশঙ্কু হতে চলেছে। এনসি-কংগ্রেস ৩১-৩৬ (এনসি ২৮-৩০, কংগ্রেস ৩-৬), বিজেপি ২৮-৩০, পিডিপি ৫-৭, আম আদমি পার্টি ১, আপনি পার্টি ১-২, সিপিএম ১, পিপলস কনফারেন্স ০-২, এআইপি ১-২ এবং নির্দল ও অন্যেরা ৫-৯টি তে জিততে পারে। অর্থাৎ প্রধান চার প্রতিদ্বন্দ্বী বাদে অন্যেরা ১০-১৬টিতে জিততে পারে।
নিউজ১৮-র পূর্বাভাস, জম্মু ও কাশ্মিরে এনসি-কংগ্রেস জোট ৪১, বিজেপি ২৭, পিডিপি ৭ এবং অন্যদের ঝুলিতে ১৫টি আসন যাওয়ার সম্ভাবনা। প্রসঙ্গত, এর আগে শেষ বার জম্মু ও কাশ্মিরে বিধানসভা ভোট হয়েছিল। পিডিপি ২৮, বিজেপি ২৫, এনসি ১৫, পিডিপি ১২ এবং অন্য প্রার্থীরা ৭টিতে জিতেছিলেন। এক দশকের ব্যবধানে অবশ্য পূর্ণ রাজ্য থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে কাশ্মির। নরেন্দ্র মোদি সরকার ২০১৯ সালের ৫ অগস্ট কেন্দ্র সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা লোপ করেছিল। সাবেক জম্মু-কাশ্মির রাজ্যকে দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, জম্মু ও কাশ্মির এবং লাদাখে ভাগ করা হয়েছিল।
২০১৪-য় অবিভক্ত জম্মু ও কাশ্মিরে ৮৭টি আসন ছিল। ৩৭০ বাতিল এবং রাজ্য ভাগের পরে লাদাখের ৪টি আসন বাদ পড়ে। এর পর জম্মু ও কাশ্মিরের আসন পুনর্বিন্যাসের দায়িত্বে থাকা ‘ডিলিমিটেশন কমিশন’-এর রিপোর্টের ভিত্তিতে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিধানসভা আসনসংখ্যা ৮৩ থেকে বাড়িয়ে ৯০ করা হয়েছিল গত বছর। সাতটি আসনের মধ্যে ছ’টি বেড়েছে জম্মুতে (৩৭ থেকে ৪৩) এবং একটি কাশ্মিরে (৪৬ থেকে ৪৭)। কমিশন জানিয়েছে, ২০১১ সালের জনসংখ্যার ভিত্তিতেই আসন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যদিও অভিযোগ উঠেছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে হিন্দুপ্রধান জম্মুতে মুসলিম প্রধান কাশ্মির উপত্যকার তুলনায় বেশি আসন বাড়ানো হয়েছে। সূত্র: সংবাদসংস্থা