বুধবার ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ১৪ কার্তিক ১৪৩১
বুধবার ৩০ অক্টোবর ২০২৪
 
মতামত
হাসিনার কারণে বাংলাদেশকে দ্বিগুণ দামে আদানির বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে





Friday, 23 August, 2024
7:45 PM
Update: 23.08.2024
7:58:44 PM
 @palabadalnet

আদানি ও হাসিনা। ফাইল ছবি

আদানি ও হাসিনা। ফাইল ছবি

ভারতের ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় আদানি গোষ্ঠীর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ পুরোটাই বিক্রি হয় বাংলাদেশে। অভিযোগ, দ্বিগুণ দামে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হয়। এমতাবস্থায়, প্রকল্প যাতে বিপাকে না-পড়ে তা নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের তরফে রাতারাতি আমদানি-রপ্তানি নিয়মাবলি সংশোধন করা হল। উৎপাদিত যে বিদ্যুৎ ছিল ১০০ শতাংশ রপ্তানির জন্য, নতুন নিয়মে তা এখন ভারতেও বিক্রি করা যাবে। লিখেছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায়।

ভারতে নির্বাচন কমিশনার অরুণ গোয়েলের নিযুক্তি মোদি সরকারের দ্রুততম সিদ্ধান্ত রূপায়ণের নজির হলে আদানি গোষ্ঠীর ত্রাণে সরকারের তৎপরতা থাকবে দ্বিতীয় স্থানে। এই সিদ্ধান্ত আরও একবার বুঝিয়ে দিচ্ছে, সরকারের আসল চালক কে। কার জন্য প্রধানমন্ত্রীর জান হাজির সবসময়। কিংবা এভাবেও বলা যায়, গৌতম আদানি-ই এই সরকারের প্রাণভোমরা। নরেন্দ্র মোদিও আদানি-অন্তপ্রাণ।

অরুণ গোয়েলকে বিদ্যুৎগতিতে কেন নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত করা হল-গত নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তা জানতে চেয়েছিল। অরুণ ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের ভারী শিল্প মন্ত্রকের সচিব। গত বছরের ১৮ নভেম্বর তিনি স্বেচ্ছাবসর নেন। পরের দিন, ১৯ নভেম্বর, সরকার তাকে নির্বাচন কমিশনার পদে নিযুক্ত করে। ২১ নভেম্বর তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে মামলা হয়। ২৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কে. এম. জোসেফের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যর সাংবিধানিক বেঞ্চ কেন্দ্রকে নিযুক্তি সংক্রান্ত ফাইল পেশ করতে বলে। তা দেখেই ওই বিস্ময়কর প্রশ্ন। দীর্ঘসূত্রতা যে-দেশের সর্বব্যাপী সরকারি ব্যাধি, সে দেশের সরকারের এই ত্বরিতগতি বিস্ময় উদ্রেক করবেই। কী কারণে এমন তৎপরতা, কার স্বার্থে, কোন উদ্দেশ্যে– এসব প্রশ্ন ওঠা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

ঘটনা হল, তাতে যে যাই বুঝুক, অরুণ গোয়েলের নিযুক্তি আটকায়নি। স্বেচ্ছাবসরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যার নিযুক্তি, নির্বাচন কমিশনার হয়ে তিনি ও তার সঙ্গীরা শাসকের কী-কী উপকারে এসেছেন, কীভাবে নিয়োগকারীর বিশ্বস্ত ও অন্ধ অনুগত হতে পেরেছে-সেসব নমুনা চতুর্দিকে ছড়ানো-ছিটানো। বিপক্ষে চলে যাওয়া জনমত কীভাবে পক্ষে হাজির করা যায়, কোন জাদুবলে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি বাড়তি ভোট ইভিএম-বন্দি হয়, লোকসভা ভোটের ফল বেরনোর পর সেই ‘প্রমাণ’ দাখিল সত্ত্বেও কমিশনকে এখনও হেলানো যায়নি। সরকারকে তো নয়ই। হেলানো-নড়ানো কঠিনও, বাংলাদেশের মতো প্লাবন না ঘটলে।

গতির নিরিখে অরুণ গোয়েলের নিযুক্তি এক নম্বর হলে দ্বিতীয় স্থান আদানি গোষ্ঠীর। তাদের স্বার্থে গৃহীত সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি আরও একবার বুঝিয়ে দিচ্ছে– এই সরকারের স্টিয়ারিং গৌতম আদানির হাতেই। রাহুল গান্ধী পাঁচ বছর ধরে যা বলে চলেছেন, যা হয়তো ফাটা রেকর্ডে পিন আটকে যাওয়ার মতো একঘেয়েমিতে ভরা, সরকারের সেই আদানি-প্রীতির আরও এক উদাহরণ এই সিদ্ধান্ত। গৌতম আদানিকে বাঁচাতে নরেন্দ্র মোদির জান কীভাবে হাজির, এটা তার আরও এক জ্বলন্ত প্রমাণ। সিদ্ধান্তটি সরকার নিয়েছে স্রেফ অনুমান ও আশঙ্কার উপর ভিত্তি করে। প্রাণভোমরা যাতে বিপদে না-পড়ে সেজন্যই এই তড়িঘড়ি প্রচেষ্টা।

বিষয়টি স্পষ্ট করতে গেলে একটু পিছনে যেতে হয়। ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় আদানি গোষ্ঠী ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন এক তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়েছে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ পুরোটাই বিক্রি হয় বাংলাদেশে। কীভাবে আদানিরা ওই বরাত পায়, কে তাদের হয়ে শেখ হাসিনাকে চাপ দিয়েছিলেন, এসব প্রশ্ন বহুবার উঠেছে। শ্রীলঙ্কার ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের চেয়ারম্যান এম. এম. সি. ফার্দিনেন্দো একবার ভরা হাটে সেই হাঁড়ি ভেঙেও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষকে নাকি নরেন্দ্র মোদি প্রবল চাপ দিয়েছিলেন, যাতে সে-দেশে আদানি গোষ্ঠী একটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে পারে।

পরে ভারতের চাপেই গোতাবায়া সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। প্রচার আছে, গোড্ডা প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপরেও নাকি তেমনই চাপ দিয়েছিলেন মোদি। এ নিয়ে সংসদে হইচই হয়েছিল। থিতিয়েও যায় কালের নিয়মে। দুই দেশের দুই কর্তৃত্ববাদী নেতা-নেত্রী বিতর্কের জল বেশি দূর গড়াতে দেননি।

বাংলাদেশে আদানি-বিতর্ক অবশ্য তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলছেই। অভিযোগ, দ্বিগুণ দামে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। হাসিনার দাপটে বিতর্ক চাপা পড়লেও অসন্তোষের আগুন নেভেনি। পালাবদলের পর নতুনভাবে তা মাথাচাড়া দিতে পারে। আদানিকে বিদ্যুতের পেমেন্ট করতে হয় ডলারে। একে বাড়তি দাম, তার উপর তীব্র ডলার সংকট। হাসিনা-পরবর্তী জমানায় পুরনো এই বিতর্ক কোন আকার ধারণ করবে এখনও অজানা।

এই পরিস্থিতিতে পরম মিত্রকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদি। বাংলাদেশে পট-পরিবর্তনের পর গোড্ডা প্রকল্প যাতে গাড্ডায় না-পড়ে তা নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় রাতারাতি আমদানি ও রপ্তানি নিয়মাবলি সংশোধন করে ফেলেছে। গোড্ডায় উৎপাদিত যে বিদ্যুৎ ছিল ১০০ শতাংশ রফতানির জন্য, নতুন নিয়মে তা এখন ভারতেও বিক্রি করা যাবে।

কত দ্রুত এই বদল একবার ভাবুন! শেখ হাসিনা দেশত্যাগী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিলেন ৫ আগস্ট। সাত দিনের মাথায়, ১২ আগস্ট বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় নিয়ম বদলে জানিয়ে দিল, উৎপাদিত বিদ্যুৎ পুরো রপ্তানি করা না-গেলে, চুক্তিতে জটিলতা দেখা দিলে, পেমেন্ট পেতে দেরি হলে, অথবা বকেয়া নিয়ে বিবাদ সৃষ্টি হলে সেই বিদ্যুৎ দেশেও বিক্রি করা যাবে। মোদ্দা কথা, গোড্ডার বিদ্যুৎ বাংলাদেশ নিতে না-চাইলে, বা না-পারলে আদানির যাতে ক্ষতি না-হয় সেই ব্যবস্থা মোদি সরকার করে দিল। সারার্থ, বাংলাদেশ যাই করুক, গোড্ডা প্রকল্প অক্ষত থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকার যখন নিয়ম বদলাচ্ছে, আদানিরা তখন জানিয়ে দিচ্ছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখতে তারা আগ্রহী।

চুক্তি অনুযায়ী, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ তারা করে যাবে। এই নিয়ম বদলের ফলে কী-কী হল দেখা প্রয়োজন। কীভাবে ভারত সরকারের রাজস্বের ক্ষতি করে আদানি গোষ্ঠী মুনাফা লুটছে বোঝা জরুরি। গোড্ডা কোনও কালেই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ (এসইজেড) ছিল না। একটিমাত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা শিল্পের জন্য কোনও এলাকাকে এসইজেড মর্যাদা দেওয়াও যায় না। কিন্তু শুধুমাত্র আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যই মোদি সরকার গোড্ডাকে ‘এসইজেড’ করেছে।

এর ফলে তারা শুল্ক, সেস, জিএসটি, আয়কর ছাড়-সহ হাজারটা সুবিধে পেয়েছে। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত জলের জোগান। আদানি গোষ্ঠী স্থানীয় চির নদীর জলের উপর নির্ভর করেনি। পরিবেশের তোয়াক্কা না করে ৭৮ কিলোমিটার পাইপলাইন পেতে সাহেবগঞ্জের গঙ্গা থেকে তারা গোড্ডায় জল এনেছে। মোদির হাত যার মাথায়, তাকে আটকায় কে? পরিবেশ-সহ কোনও মন্ত্রকেরই আপত্তি ধোপে টেকেনি। ঝাড়খণ্ডের নিয়ম ছিল, উৎপাদিত বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ রাজ্যকে বেচতে হবে। সেই নিয়মও তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম তাকে করতেই হত।

আদানি-মোদি মাখামাখি নিয়ে যতটুকু হইচই কংগ্রেসই করে, ইদানীং অন্যরাও করছে। নিয়ম বদল নিয়ে কংগ্রেসের জয়রাম রমেশ সরব হয়েছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের জহর সরকারও। জয়রামের কটাক্ষ, ‘প্রিয় টেম্পোওয়ালার স্বার্থে ঘা পড়লে অজৈবিক প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎগতিতে অগ্রসর হন। আদানি একমাত্র সংস্থা যারা অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা এনে ঝাড়খণ্ডে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে বাংলাদেশে বেচে। সেই বিদ্যুৎ এখন দেশেও বিক্রির অনুমতি দেওয়া হল।’ আর, জহর লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে হাসিনা ও ভারত-বিরোধী অসন্তোষের একটা কারণ আদানিদের সঙ্গে চুক্তি, যা মোদিকে খুশি রাখতে করা। সরকার এখনও এ নিয়ে আমার প্রশ্নের জবাব দেয়নি। তথ্যও জানায়নি।’

মোদি-আদানি নিয়ে এসব তথ্যের প্রত্যাশা অর্থহীন। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের দ্বিতীয় বোমা আদানিদের সঙ্গে সেবি-র চেয়ারপার্সন মাধবী পুরী বুচের স্বার্থের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করেছে। ভূত তো সরষেতেই। কিন্তু তাতে কী? সুপ্রিম কোর্ট তো এখনও স্থবির! দুর্নীতির প্রমাণের তালিকা যত বাড়ছে তত বেশি তুলে ধরা হচ্ছে ভারত-বিরোধী চক্রান্তের তত্ত্ব। এই ধরনের তত্ত্ব ও অসাড় অজুহাত শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে পারেনি। মোদি বাঁচছেন দেশটা বিচিত্র বলে!


  সর্বশেষ খবর  
  সবচেয়ে বেশি পঠিত  
  এই বিভাগের আরো খবর  


Copyright © 2024
All rights reserved
সম্পাদক : সরদার ফরিদ আহমদ
নির্বাহী সম্পাদক : জিয়াউর রহমান নাজিম
ফোন : +৮৮-০১৮৫২-০২১৫৩২, ই-মেইল : [email protected]