বুধবার ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ১৪ কার্তিক ১৪৩১
বুধবার ৩০ অক্টোবর ২০২৪
 
মতামত
আওয়ামী লীগের ভাঙা সাংস্কৃতিক বোমা ও নতুন বাংলাদেশ





কাজী জেসিন
Wednesday, 14 August, 2024
12:51 AM
 @palabadalnet

কিছু দৃশ্য ভোলা যায় না। কিছু দৃশ্য আমরা কোনোদিন ভুলবো না। নিজের দেশের মাটিতে নিজেদের শাসকের বুলেটে শত শত তরুণ-ছাত্রকে করুণভাবে হত্যা করা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ ছাত্রকে চিকিৎসা পর্যন্ত নিতে বাঁধা দেয়া হয়েছে। প্রায় মৃত বুলেটবিদ্ধ ছাত্রকে সাঁজোয়া যান থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি এবং পুলিশ কমিশনারকে এক পুলিশ অফিসার দেখাচ্ছেন কীভাবে তিনি একের পর এক হত্যা করেছেন। এবং তারা ভীষণ নির্লিপ্তভাবে তা দেখছেন। যেন বুঝে নিচ্ছেন পুলিশ নির্দেশ ঠিকমতো পালন করছেন কি-না। এই দৃশ্য বিশ্বের যেকোনো নির্মমতাকে হার মানায়।

রক্তের দাগ এখনও শুকায়নি, এরই মাঝে শুরু হয়েছে নতুন খেলা। গুম, খুন, হত্যার হোলি-খেলার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা আওয়ামী লীগ একই পথে আবারও এখন তাদের 'হারানো স্বর্গ' ফিরে পাবার লক্ষ্যে নানামুখি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

আওয়ামী লীগের মূল রাজনৈতিক পুঁজি বা 'সেলিং পয়েন্ট'র একটি  ছিল 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'।এই দলটি মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর একটি বড়ো অংশের মধ্যে এই বিশ্বাস একসময় সৃষ্টি করতে পেরেছিল যে, তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি।

আওয়ামী লীগ নেত্রী নিজে যুদ্ধাপরাধীর ঘরে তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিয়ে, তাদেরকে নিজ পরিবারের সদস্য করে, বিচারের ব্যবস্থা করেছিলেন বিরোধী রাজনীতির কথিত যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচিত এক বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধ্বজাধারী হয়ে নিজের দলের বাইরের প্রতিটি নাগরিককে তারা চিত্রিত করেছে রাজাকার হিসেবে। বিরোধীমতের সকলকে আখ্যা দেয়া হয়েছে পাকিস্তানের দোসর বলে।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাণিজ্য করতে করতে রাজনৈতিক মুনাফায় ফুলে ফেঁপে ওঠা আওয়ামী লীগ বৈষম্যের বিরুদ্ধে দেশের মেধাবী তরুণ প্রতিবাদী ছাত্রদেরকেও অভ্যাসবসত রাজাকার বললে, কে আসলে একুশ শতকের রাজাকার, কে আসলে দেশ-বিরোধী শক্তি তা' দিনের আলোর মতো দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। জন্ম হয় এক নতুন বাংলাদেশের। উন্মোচিত হয় বাংলাদেশের জন্য এক নতুন দিগন্ত। আর আওয়ামী লীগ হারিয়ে ফেলে তাদের দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করা পুঁজি, তাদের রাজনীতির মূল সেলিং পয়েন্ট। আর তাই ছাত্রদের মিছিলে সারাদেশ মুখরিত হয়ে ওঠে 'ভুয়া' শব্দে।

ছাত্রদের খুনের অপরাধ কাঁধে নিয়ে পরাজিত আওয়ামী লীগ এখন দেশের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার জন্য এবং দল হিসেবে টিকে থাকার জন্য ব্যাবহার করছে তাদের দ্বিতীয় পুঁজি - সাম্প্রদায়িকতা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল প্রায় ষোলো বছর। এই ষোলো বছরে বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমেছে। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে আমরা দেখি ২০১১ সালে ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুরা জনসংখ্যার ৯.৬১ শতাংশ ছিল, যার মধ্যে হিন্দু ছিল ৮.৫৪ শতাংশ, বৌদ্ধ ০.৬২ শতাংশ, খ্রিস্টান ০.৩১ শতাংশ এবং অন্যান্য ০.১৪ শতাংশ। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যা ৭.৯৫ শতাংশে নেমে আসে। তারপরেও এই দলটিই সংখ্যালঘুদের রক্ষার দাবি করে।

এছাড়া আমরা দেখেছি বিগত পনেরো বছরে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর অসংখ্য নিপীড়নের ঘটনা। শেখ হাসিনার অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং নানা সময়ে পুরস্কৃত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ দখল করেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের শত শত বিঘা জমি।  মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে গোপালগঞ্জের হিন্দুদের ‘শত শত বিঘা’ জমি দখলের অভিযোগ এনে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ওই এলাকা ঘুরে দেখার অনুরোধও জানিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা  কি হিন্দু সম্প্রদায়ের দখল হয়ে যাওয়া জমি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ? গোপালগঞ্জ শেখ হাসিনার নিজের নির্বাচনী এলাকা। তিনি নিজের এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা দিতেও কোনো  উদ্যোগ নেন নি।    

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ২০২১ সালের প্রতিবেদন  অনুযায়ী, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে '২১-এর  সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ৩,৬৭৯টি আক্রমণ সংঘটিত হয়েছে।

২০১৯ সালে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের  অধিকার রক্ষায় কাজ করা প্রতিষ্ঠান 'শাড়ি'র পরিচালক প্রিয়া সাহা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ৩৭ মিলিয়ন মানুষ নিখোঁজ। কারা তাদের গৃহহারা করেছে জানতে চাইলে প্রিয়া সাহা ইতঃস্তত করে মুসলিম ফান্ডামেন্টালিস্টদের কথা বলেন এবং তিনি এও বলেন যে, এই মৌলবাদীরা সবসময় রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে। তিনি বলেছিলেন বিচার না পাবার কথা। লক্ষ্য করতে হবে ২০১৯ সালে তিনি যখন এই কথা বলছেন তখন ইতোমধ্যে আওয়ামী শাসনামলের প্রায় ১০ বছর পেরিয়েছে। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে আওয়ামী শাসনামলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছে। আমি মনে করি, আজ আমাদের এই তথ্যগুলো ঘেঁটে দেখার সময় এসেছে। জানা দরকার, কেন প্রিয়া সাহাকে সেদিন ওবায়দুল কাদের মামলার হুমকি দিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় যে ট্রাম কার্ডটি আওয়ামী লীগ ব্যবহার করে আসছে তা হলো 'অসাম্প্রদায়িকতা'। ভারত ও পাশ্চাত্যের ইসলামফোবিয়ার ফায়দা হাসিল করতে দৃশ্যপটে  ইসলামী মৌলবাদকে তুলে ধরা এবং নিজেদের অসাম্প্রদায়িকতার বাহক হিসেবে হাজির করা তাদের আরেকটি কৌশল। সে অপকৌশলের অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগ এক ঢিলে দুই পাখি মেরে চলেছে বহু বছর ধরে। এখন যখন আমরা দেখি যে, বিভিন্ন মন্দিরে আওয়ামী লীগ নেতাদের আদেশে হামলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কর্মীরা প্রতিবেশী হিন্দুর বাড়িতে হামলা করছে, গাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে, আমাদের জানার সময় এসেছে বিগত সময়গুলোতে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল তখন কিভাবে ৩৭ মিলিয়ন (প্রিয়া সাহার তথ্যমতে) হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী গুম হয়েছে এবং কীভাবে অপরাধীরা রাজনৈতিক প্রশ্রয় পেয়েছে। কারা ছিল তারা?  ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ইসলামিস্টের মুখোশ পরে বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, নিপীড়ন কারা করেছে- তা জানার সময় এসেছে এখন।

আমরা যা বিশ্বাস করি তার বেশিরভাগই ক্ষমতাবানদের তৈরি করা ন্যারেটিভ। আর এই বয়ানের বাইরের কিছু দেখলে তা আমাদের অবাক করে, এবং অনেকে তা ইগনোরও করেন, কারণ তাতে তাদের লাভ হয়। কিন্তু যত দ্রুত আমরা সত্যকে অনুধাবন করবো, যত তাড়াতাড়ি আমরা মিলনের সম্ভাবনাকে আলিঙ্গন করবো তত দ্রুত আমরা ক্ষত কাটিয়ে জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে পারবো।

দ্বিতীয় স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সংযুক্ত হয়েছে এক নতুন দৃশ্য। মন্দির পাহারা দিচ্ছেন মাদ্রাসার ছাত্ররা। এই সৌহার্দ্য, এই দায়িত্ববোধ, এই ঐক্যের গুরত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিগত তিনটি মেয়াদে নগ্ন হস্তক্ষেপ করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে নানান সুবিধা নিয়ে আসা ভারত এখন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর উপর নির্যাতনের কাহিনীকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করছে। তারা মিথ্যা তথ্য প্রচার করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করছে। আওয়ামী লীগ ও ভারত উভয় মিলে যা করছে তা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের জন্যই ভয়ানক ক্ষতিকারক।

বিগত ক’দিনে এ পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি যেখানে আমরা দেখতে পাই যে, বাংলাদেশে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম কোনো হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান পরিবারের উপর হামলা করেছে। অথচ অনেকেই এটা প্রচার করতে ভালোবাসে যে, ইসলামিক আইন যারা পাঠ করছে তারাই প্রতিক্রিয়াশীল এবং তারাই হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টানদের উপর হামলা করে। এই ইসলামোফোবিয়া থেকে বাংলাদেশের মানুষ বের হয়ে আসছে। গত ক’দিনে মাদ্রাসার ছাত্রদের লক্ষ্য করে আমি হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেককে বলতে শুনেছি: “এই ভাইরা আমাদের পাহারা দিয়েছেন।”

দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ তাদের দ্বিতীয় সেলিং পয়েন্টটাও হারিয়ে ফেলছে। দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার  গুল্মে আগুন দিয়ে উত্তাপ ছড়াতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে বেঁচে উঠছে। আমাদেরকে বাঁচতে হবে সবাইকে নিয়ে, সকলে মিলে, একসাথে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের বাঁচাতে সবাই এগিয়ে আসুন।আর একটি হিন্দু, বৌদ্ধ, বা খ্রিস্টান ভাইয়ের গায়ে যেনো কোনো আঘাত না আসে।আর একটি বোনের যেন আতংকে থাকতে না হয়  একদিনও।

আফ্রিকান বিপ্লবী লেখক নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গোর কথা, “সাম্রাজ্যবাদ সবচেয়ে বড় যে অস্ত্র প্রতিদিন সম্মিলিত প্রতিরোধের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে তা হলো সাংস্কৃতিক বোমা। সাংস্কৃতিক বোমার প্রভাব হলো মানুষের নাম, তাদের ভাষা, তাদের পরিবেশ, তাদের সংগ্রামের ঐতিহ্য, তাদের ঐক্য, তাদের সক্ষমতা এবং শেষ পর্যন্ত নিজেদের ওপর বিশ্বাসকে ধ্বংস করা।” এরকম মানসিক নিয়ন্ত্রণ যে কোনো প্রভাবশালী শক্তি দ্বারা সম্পন্ন হতে পারে, যা আওয়ামী লীগ এতদিন ধরে করে এসেছে। আশার  কথা হলো আওয়ামী লীগের সেই সাংস্কৃতিক বোমা ধ্বংস হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ এক অন্ধকার গভীর গর্ত থেকে উঠে আসছে, আমাদের সন্তানসম ছাত্রদের প্রাণের  বিনিময়ে। এ এক অদ্ভুত করুণ সত্য! মার্ক টোয়েন বলেছেন, "সত্য গল্পের চেয়েও অদ্ভুত, তবে তা সম্ভবত এজন্যই যে, গল্প সম্ভাবনার মধ্যে সীমাবদ্ধ; সত্য নয়।"

কাজী জেসিন: সিনিয়র সাংবাদিক

মানবজমিনের সৌজন্যে


  সর্বশেষ খবর  
  সবচেয়ে বেশি পঠিত  
  এই বিভাগের আরো খবর  


Copyright © 2024
All rights reserved
সম্পাদক : সরদার ফরিদ আহমদ
নির্বাহী সম্পাদক : জিয়াউর রহমান নাজিম
ফোন : +৮৮-০১৮৫২-০২১৫৩২, ই-মেইল : [email protected]