মনে আছে তিনটি স্তর-চেতন, অবচেতন আর অচেতন। স্যুরলিয়স্টিক কবিরা জেগেও স্বপ্ন দেখেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নলোকে চলে যান। ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। real and unreal, meditation and action মিশে একাকার হয়ে যায়। যা যুক্তিগ্রাহ্যও নয় আবার বিশ্বাসযোগ্যও নয়। অথচ মনকে দুর্নিবার আকর্ষণ করে টেনে নেয়। স্বপ্ন স্বপ্নের সঙ্গে মিশে যায়। এ অবস্থাকে পরাবাস্তব বা সুররিয়ালিস্ট বলে। কল্পনায় যখন সীমা ছেড়ে যায় তখন জন্ম হয় পরাবাস্তব চিত্রকল্পের। অবচেতন মনের কল্পনা থেকেই সৃষ্টি হয় পরাবাস্তব চিত্রকল্প। পরাবাস্তবতা অবচেতনের প্রতীকী ভাষা; এটি একটি সর্বজনীন যে ভাষা শিক্ষা, সংস্কৃতি বা বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভর করে না। এর লক্ষ্য পরাবাস্তববাদী আন্দোলন ছিল ভৌত নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। এটি একটি পরিচয় করিয়ে দেয় বৈপ্লবিক ধারণা যা দাদাবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিল্প জগতে ছড়িয়ে পড়ে। কল্পনায় যখন সীমা ছেড়ে যায় তখন জন্ম হয় পরাবাস্তব চিত্রকল্পের। অবচেতন মনের কল্পনা থেকেই সৃষ্টি হয় পরাবাস্তব চিত্রকল্প। জীবনানন্দ দাশের পথ ধরে কাব্যসাহিত্যে প্রথম ব্যাপকভাবে পরাবাস্তব অনুষঙ্গের কবিতা লেখেন শামসুর রাহমান। তার আগে আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান চেষ্টা করেছেন। তাদের সে উদ্যোগ চেষ্টার পর্যায়েই ছিল। তবে জীবনানন্দকে আলোকবর্তিকা হিসেবে এবং পরে প্রভাবমুক্ত হয়ে বিস্তৃত পরিসরে শামসুর রাহমান কবিতায় পরাবাস্তব উপাদানের কবিতা লেখেন। তার এ উদ্যোগ যথেষ্ট সফল। পরবর্তীতে আব্দুল মান্নান সৈয়দ এ ধারার সফল প্রয়োগ করেন।
বাংলাকাব্যে প্রথম খাঁটি স্যুররিয়লিস্ট কবি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশ। কোনো-কোনো কবিতায় অবচেতন মনে কথা বলেছেন তিনি। তার কবিতায় ‘হিরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস হাসে’, অথবা ‘স্বপ্নের ভিতরে হরিণেরা খেলা করে’। ‘শিকার’ কবিতায় স্যুয়ালিস্টিকের রঙে আকাশের রঙ হয় ঘাসফড়িঙের মতো। পরাবাস্তবতার উপাদান রয়েছে এমন কবিতা নাবিক, হাঁস, মহিলা, গোধূলি সন্ধির নৃত্য (সাতটি তারার তিমির), রাত্রি এবং জয়জয়ন্তীর সূর্য, সময়ের তীরে, (বেলা অবেলা কালবেলা), শিকার, হরিণেরা, নগ্ননির্জন হাত, বেড়াল, (বনলতা সেন), নিরালোক, পরিচায়ক, শ্রাবণ রাত, শব, স্বপ্ন, আজকের এক মুহূর্ত, (মহাপৃথিবী) কবিতায়। গাছের ছায়ায় রোদের ভেতর সে মাছের কাঁটা খোঁজে। রোদের মধ্যে বেড়ালের জীবনসংগ্রাম-
‘সারাদিন একটা বেড়ালের সঙ্গে ঘুরে ফিরে কেবলই আমার দেখা হয় :
গাছের ছায়ায় রোদের ভিতরে,
বাদামি পাতার ভিড়ে :’
(বেড়াল, বনলতা সেন)
জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যে পরাবাস্তবতার চিত্র দেখা যায়। ‘বনলতা সেন’ কাব্যের হাওয়ার রাত, বিড়াল কবিতায়; ‘মহাপৃথিবী’, কাব্যের শ্রাবণ রাত, নিরালোক, স্বপ্ন ইত্যাদি কবিতায় এবং ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যের যেইসব শেয়ালেরা, ঘোড়া, হাঁস কবিতায় এ চিত্র দেখা যায়। সিন্ধুসারস, নীলাভতম চেষ্টা, মাছির মতো ঝরে, ক্ষুধার বিবরে, হেমইে্রু কুয়াশা প্রভৃতি কবিতায় পরাবাস্তব রঙ মিশে আছে। অন্যান্য কিছু কিছু কবিতায় হালকাভাবে এ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।
(১) ‘যে ঘোড়ায় চড়ে আমি অতীত ঋষিদের সঙ্গে আকাশে নক্ষত্রে উড়ে যাবো’ (আজকের এক
মুহূর্ত/মহাপৃথিবী)
(২) ‘চোখ তুলে আমি... সেই মুখের ভেতর প্রবেশ করলাম’
(শ্রাবণ রাত/মহাপৃথিবী)
(৩) ‘হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল-রাঙা-
চুপে-চুপে ডুবে যায় জ্যোৎস্নায়’
(গোধূলিসন্ধির নৃত্য, সাতটি তারার তিমির)
(৪) ‘আমাদের হাড়ে এক নির্ধূম আনন্দ আছে জেনে
পঙ্কিল সময়স্রোতে চলিতেছি ভেসে
তা না হলে সকলি হারায়ে যেতো ক্ষমাহীন রক্তে নিরুদ্দেশে’
... নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয় লিবিয়ার জঙ্গলের মতো’
(রাত্রি, বেলা অবেলা কালবেলা)
সৈয়দ আবদুল মান্নানের (মান্নান সৈয়দ নামেই পরিচিত) কবিতা বিষয়ে শওকত ওসমান বলেছিলেন : ‘মান্নান আঙ্গিকের দিক থেকে পুরোপুরি পরাবাস্তবতাবাদী’। কবি মান্নান সৈয়দ (জন্ম : ৩ আগস্ট ১৯৪৫-মৃত্যু : ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০) বলেন, ‘স্যুররিইয়ালিজমই হলো প্রকৃত বাস্তবতা’। পরাবাস্ততাকে স্যুররিয়িলিজম বলা হয়। ডাডা-ইজম-এর পরবর্তী সংস্করণ হচ্ছে স্যুররিয়ালিস্ট। বাংলা কবিতায় প্রথম জীবনানন্দ পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেন। এরপর সৈয়দ আলী আহসান চেষ্টা করেন। শামসুর রাহমান বেশ সফলও হন। সৈয়দ শামসুল হকও কবিতায় পরাবাস্ততার চেষ্টা করেন। এরপর বিস্তৃতভাবে সৈয়দ মান্নান কবিতায় পরাবাস্তবতার ব্যাপক ও সফল প্রয়োগ ও আলোচনা করেন।
মান্নান সৈয়দ ষাটের দশকের সবচেয়ে শিল্পসচেতন কবি। তার ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’র (১৯৬৭) অনেক কবিতাই পরাবাস্তবতার রঙে রচিত। এছাড়া ‘জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসার’ (১৯৬৯), ‘পরাবাস্তববাদী কবিতা’ (১৯৮২) গ্রন্থের অনেক কবিতায় তিনি পরাবাস্তবাদের চাষ করেন। পরাবাস্তবতা হচ্ছে এমন এক ধরনের বাস্ততা যে বাস্ততার সাথে চাক্ষুষ বাস্ততার কোনো মিল নেই। কিছু মিল থাকতেও পারে অবশ্য। বস্তুত এ-চেতনার মূল ভিত্তি হলো যুক্তিহীন ও অবচেতন। ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক ধারণার সঙ্গে পরাবাস্ততা বা স্যুররিয়িলিজম প্রায় একই বন্ধনীতে রাখা যায়। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের ভাবনা হচ্ছে, মানুষ অবচেতন মনে অনেক কিছুই করে বা ভাবে। তিনি বলেন, এ ভাবনা চেতন মনের চেয়ে অবচেতন মনেরই বেশি। পরাবাস্ততা হচ্ছে মানুষের চেতনটা যখন শিথিল হয় তখন মানব মনে অবচেতন প্রভাব ফেলে। এটি হচ্ছে কবির প্রতীক ও চিত্রকল্পগুলোর মধ্যে যোগসূত্র। মূলত সুইজারল্যান্ড থেকে উঠে আসা ‘ডাডাইজম’-এর পরবর্তী আন্দোলন হচ্ছে ‘স্যুররিয়েলিজম’ বা ‘পরাবাস্ততা’।
মার্ক আর্নেস্টের সংজ্ঞা আমরা তুলে ধরতে পারি। স্যুররিয়েলিজমকে তিনি বলেছেন : ‘সুর রিয়ালিস্টের লক্ষ্য হচ্ছে অবচেতনার বাস্তব চিত্র আঁকা নয় কিংবা অবচেতনার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে কল্পনার আলাদা এলাকা সৃষ্টি করাও নয়। এর লক্ষ্য হলো চেতন ও অবচেতন মনের সাথে বাইরের জগতের সব দৈহিক ও মনের বেড়া তুলে দেয়া’। ‘তেলোর ভিতরে স্তন আর/ বিছে পরা¤পরাক্রমে যাতায়াত করে কেন’ অথবা ‘আজ আমি প্রথম শিশুর মতো/হারমোনিয়াম ঊহৃ করার পরেকার বাতাসে লেগে থাকা সুরের মতো’ পরাবাস্তবাতার উপাদান মেলে-সৈয়দ মান্নানের কবিতায় পরাবাস্ততার রঙ মিশে আছে। প্রতিনিধি হিসেবে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।
১) ‘দেখেছি ঘাসের মেঝে ছিন্ন, লাল মুন্ডু নিয়ে খেলে বিনা অপব্যয়ে : সূর্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে কালো রেলগাড়ি; আল্লাহ আছেন তার অবাক সৃষ্টিতে গালে হাত দিয়ে, মানে বৃষ্টি হচ্ছে, যেন ছেলেরা চলেছে স্কুলে (রাত্রিপাত কবিতায়)’।
২) ‘পরিবর্তনের ছাদ বিড়ালের মতো অন্যমনস্ক হবার সুযোগে পা টিপে-টিপে এগোল আমার খোঁড় আকাঙ্ক্ষা, বরফের মানুষ নাজেহাল ছোটো-ছোটো নুড়ির আওয়াজে-যখন দর্জি কাপড় হয়ে গেল মাংসভুক চেষ্টায় (একেকটি দিন একেকটি সবুজভুক সিংহ)’।
৩) “জ্যোৎস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়, সব দরোজায়, আমার চারিদিকে বাস একটি নক্ষত্র, পুলিশ একটি নক্ষত্র, দোকান একটি নক্ষত্র : আর সমস্তের ওপর বরফ পড়ছে। থ এ রকম দৃশ্যে আহত হয়ে আমি শুয়ে আছি পথের উপর, আমার পাপের দুচোখ চাঁদ ও সূর্যের মতো অন্ধ হয়ে গেল, আর যে-আমার জন্ম হলো তোমাদের করতলে মনোজ সে অশোক সে : জ্যোৎস্না তার কাছে ভূত কিন্তু একটি গানের উপর, দরোজা তার কাছে পুলিশ কিন্তু একটি জন্মের উপর, মৃত্যু তার কাছে দোজখ কিন্তু একটি ফুলের উপর’’ (অশোককানন)’।
(৪) ‘পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ ঝরনা থেকে নেমে এসেছিল।/এখন, রহস্যময় জলে, খেলা করে অবিরল।/পদ্মায় গিয়েছে একটি-মেঘনায়-যমুনায়-সুরমায়-/আর-একটি গোপন ইচ্ছায়। পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ/ঝরনা থেকে নেমে এসে সাঁতরে চলে বিভিন্ন নদীতে... (পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ)’।
পরাবাস্তবতার কবিতা বাংলা সাহিত্যে খুব কম। ফলে এটি মর্যাদাকর একটি বিষয়। এটি নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করা যেতে পারে। বর্তমানের অপেক্ষাকৃত তরুণ কবিরা কবিতায় পরাবাস্ততার চর্চা করার অনেক সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন। জীবনানন্দ দাশ বা আব্দুল মান্নান সৈয়দ আমাদের জন্য পাথেয় হতে পারে, আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করতে পারে। মান্নান সৈয়দ জীবনানন্দ নিয়ে বেশি কাজ করেছেন। পরাবাস্তবতা নিয়ে আলোচনাও করেছেন।