বেশ কয়েক বছর ধরে আলোচনার পরে অবশেষে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ভারতের কাছে ৩১টি এমকিউ- নাইন বি ড্রোন বিক্রির চুক্তিতে অনুমোদন দিয়েছে। ওই ড্রোন এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশী আর কোনো দেশের কাছে আপাতত নেই।
চীনকে চাপে ফেলতেই আমেরিকা ভারতের কাছে এই সামরিক ড্রোন বিক্রিতে অনুমোদন দিল বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন।
এখন গোয়েন্দা নজরদারি চালানোর জন্য এমকিউ-নাইন বি ড্রোন ভাড়া করে ব্যবহার করছে ভারত। জেনারেল অ্যাটমিক্স এরোনটিকাল সিস্টেমস্ সংস্থাটি এই ড্রোন সরবরাহ করবে।
পেন্টাগন বলছে, এই চুক্তিটি অনুযায়ী ড্রোন ছাড়া ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামও ভারতের কাছে বিক্রি করা হবে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের খবর, প্রায় চার শো কোটি ডলার মূল্যের চুক্তি এটি।
ভারত ২০১৮ সালে প্রথম সামরিক ব্যবহারের জন্য এ ধরনের ড্রোন আনার কথা বলেছিল। তবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অনুমতি পাওয়ার পরেই যে চুক্তি চূড়ান্ত হয়ে গেল, তা নয়। কিন্তু তাদের অনুমোদন চুক্তি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা দূর হল বলে মনে করা হচ্ছে।
আমেরিকায় শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী গুরপতওয়ন্ত সিং পান্নুর কথিত হত্যা ষড়যন্ত্রের বিষয়টি গত বছর সামনে আসার পরে এই সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির চুক্তিটি বাধার সম্মুখীন হয়।
মার্কিন ডেমোক্র্যাট এমপি বেন কার্ডিন সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির প্রধান। তিনি বলছেন যে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র নিয়ে তদন্তের আশ্বাস দেওয়ার পরই তিনি তার অবস্থান পরিবর্তন করেন। তিনি বলেন, “বাইডেন প্রশাসন জানিয়েছে যে এই ধরনের কার্যকলাপের জন্য তদন্ত হওয়া উচিত এবং ভারতেও এই ধরনের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি করা উচিত।”
ন্যাটোর বাইরের প্রথম দেশ
সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে যে গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন সরকারি সফরে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন, তখন ভারতের তরফ থেকে বাইডেন প্রশাসনকে এই চুক্তিটি নিয়ে দ্রুত এগোতে অনুরোধ করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র এতদিন এই ড্রোন শুধুমাত্র ন্যাটোভুক্ত দেশগুলিতেই দিয়ে এসেছে। ভারতই হবে প্রথম দেশ, যারা ন্যাটো-ভুক্ত না হয়েও এই ড্রোন পাচ্ছে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক রাহুল বেদী বিবিসি হিন্দিকে বলেছেন, “২০১৬ সালে ভারত মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিমের (এমটিসিআর) আনুষ্ঠানিক সদস্য হওয়ার পর থেকেই এই ড্রোন কেনার চিন্তাভাবনা শুরু হয়। ভারত যদি এমটিসিআর-এ সই না করত, তাহলে এই ড্রোনগুলি তারা পেত না। এমটিসিআর চুক্তি স্বাক্ষরের পরই ভারত আমেরিকাকে এই সশস্ত্র ড্রোন কেনার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠায়।”
“এক্ষেত্রে আমেরিকা আরো একটা বিষয় বিবেচনা করেছে। চীন যেভাবে এশীয় অঞ্চলে ক্ষমতা বাড়াচ্ছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তা বাড়া স্বাভাবিক। তাই ভারতকে অত্যাধুনিক ড্রোন দিয়ে তারা এদিক থেকে চীনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দিল,” বলছিলেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার প্রবীর সান্যাল।
কেমন এই ড্রোন?
চুক্তি সম্পন্ন হলে তার আওতায় যোগাযোগ ও নজরদারির সরঞ্জাম পাবে ভারত। এছাড়াও ১৭০টি এজিএম ওয়ান ওয়ান ফোর-আর হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও ৩১০টি ‘লেজার স্মল ডায়ামিটার বোমাও পাবে ভারত। ওই বোমা একেবারে নিখুঁত ভাবে নিশানায় আঘাত করতে পারে।
তবে এমকিউ-নাইন বি ড্রোনটিই এইসব সরঞ্জামের মধ্যে সবথেকে উল্লেযোগ্য ও সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
জেনারেল অ্যাটমিক্সের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একই নামে দুই ধরনের ড্রোন রয়েছে তাদের। একটির নাম ‘স্কাই গার্ডিয়ান’ আর অন্যটি ‘সি গার্ডিয়ান’, যেটি সমুদ্রের ওপরে নজরদারির কাজে বেশি পারদর্শী। দুই ধরনের ড্রোনই কেনার কথা ভারতের।
সংস্থার ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে যে এই ড্রোনগুলি দূর নিয়ন্ত্রিত বিমান ব্যবস্থা বা ‘রিমোটলি পাইলটেড এয়ারক্রাফট সিস্টেম (আর পি এ স)। সাধারণ বিমানের পাইলট বিমান-চালনার সময়ে যেমন দেখতে যান, বহু দূর থেকে এই ড্রোন পরিচালনাকারী পাইলটও তেমনই সবকিছু দেখতে পাবেন। এতে রয়েছে আধুনিক রেডার সিস্টেম ও সেন্সর। এটি নিজে থেকেই আকাশে উড়তে আর অবতরণ করতে পারে এবং একটানা ৪০ ঘণ্টা উড়তে পারে এই ড্রোনগুলি।
‘সামরিক শক্তি কয়েক গুণ বেড়ে যাবে’
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার প্রবীর সান্যাল বলছেন, “এটা পৃথিবীর সেরা ড্রোন। ভবিষ্যতে পাকিস্তান বা চীনের সঙ্গে কোনও যুদ্ধ বাধলে আমাদের সামরিক শক্তি কয়েক গুণ বেড়ে যাবে এই ড্রোন পেলে। চীনের কাছে যে ড্রোন আছে, মার্কিন ড্রোনের সঙ্গে তার কোনও তুলনাই চলে না। মার্কিন প্রযুক্তি এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। তাই যুদ্ধের পরিস্থিতিতে ভারতের আঘাত করার শক্তি অনেকটাই বেড়ে যাবে। তবে এই ড্রোনগুলিকে ঠিক কী কী কাজে ব্যবহার করা হবে, সেটা তো সামরিক আর রাজনৈতিক শীর্ষ নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেবেন।”
তিনি আরো বলছিলেন, “ভারতের দেশীয় যে ড্রোন শিল্প, তারাও উন্নত মানের সামরিক ড্রোন তৈরি করছে। যতদিন না সেগুলো হাতে আসছে, ততদিন মার্কিন ড্রোন দিয়েই চলবে।”
স্কাই গার্ডিয়ান ড্রোন সারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধবিগ্রহ থেকে শুরু করে পরিবেশ এবং মানবিক অভিযান-অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়েছে।
স্কাই গার্ডিয়ান সাধারণ বাণিজ্যিক বিমানের মতো উড়তে পারে আবার সামরিক বাহিনীও তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, গোয়েন্দা নজরদারি, তথ্য সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা যাবে এই ড্রোন।
ড্রোন দিয়ে কী করবে ভারত?
এ ধরনের সশস্ত্র ড্রোন যুদ্ধবিমানের মতোই লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা নিক্ষেপ করতে পারে। এই ড্রোনগুলি যেমন নজরদারি এবং উদ্ধার অভিযানে যেতে সক্ষম আবার তাদের সশস্ত্র সংস্করণটিতে হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র থাকবে। দূরপাল্লার গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও নজরদারি ছাড়াও এসব বিমান মানবিক সহায়তা, দুর্যোগের সময়ে ত্রাণ পৌঁছন, নিহত -আহতদের খুঁজে বের করে উদ্ধার, আকাশপথে আগাম সতর্কতা দেওয়ার মতো কাজও করবে।
এছাড়াও, এই ড্রোনগুলি মাদক পাচার এবং জলদস্যুতার মতো পরিস্থিতি মোকাবিলাতেও মোতায়েন করা যেতে পারে।
জানা যাচ্ছে যে মোট ৩১টি ড্রোনের মধ্যে ১৫টি ড্রোন ভারতীয় নৌবাহিনীকে এবং আটটি ড্রোন সেনা ও বিমানবাহিনীকে দেয়া হবে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের ওপরেও নজর রাখতে এসব ড্রোন ব্যবহার করা হবে।