গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলা ও পরে গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হামাস যেসব অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে অস্বাভাবিক একটি উৎস থেকে। ইসরাইলের সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, সেই উৎস হলো ইসরাইলের সামরিক বাহিনী।
সামরিক বিশ্লেষকেরা বহু বছর ধরে বলে আসছেন যে গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর অবরোধের মধ্যেও হামাসের কাছে এত ভারী অস্ত্র থাকার কারণ হলো, গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে তৈরি করা পথে চোরাচালানের মাধ্যমে এসব অস্ত্র তাদের হাতে আসে। কিন্ত অস্ত্রবিশেষজ্ঞ এবং ইসরাইল ও পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সাম্প্রতিক গোয়েন্দা তথ্যে উঠে এসেছে, গাজায় ইসরাইলের ফেলা অবিস্ফোরিত হাজার হাজার গোলাবারুদ দিয়ে নিজেদের জন্য রকেট ও ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা তৈরি হয়েছে হামাসের। এ ছাড়া ৭ অক্টোবর হামলার সময় ইসরাইলের সামরিক ঘাঁটি থেকে লুট করা অস্ত্রও যোদ্ধাদের হাতে তুলে দিচ্ছে হামাস।
গত কয়েক মাসের লড়াইয়ের সময়ে সংগৃহীত গোয়েন্দা তথ্যে উঠে এসেছে, হামাসের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ৭ অক্টোবরের আগে যেভাবে ভুল মূল্যায়ন করেছে, ঠিক তেমনি তাদের সামরিক সক্ষমতার বিষয়টিকেও ছোট করে দেখেছে ইসরাইল।
এখন এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে বিগত ১৭ বছরের গাজা অবরোধকালে সেখানে ইসরাইলের সশস্ত্র বাহিনী যেসব অস্ত্র ব্যবহার করেছে, এখন সেগুলোই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিস্ফোরক ইসরাইলে বৃষ্টির মতো রকেট ছোড়া এবং প্রথমবারের মতো গাজা থেকে ইসরাইলি একটি শহরে ঢুকে হামাসকে হামলা চালানোর সামর্থ্য তৈরি করে দিয়েছে।
৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার পর বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সীমানাবেড়া ভেঙে হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলে ঢোকার কয়েক ঘণ্টা পর রেইম সামরিক ঘাঁটির বাইরে সশস্ত্র এক হামাস যোদ্ধার মরদেহ দেখতে পান চার ইসরাইলি সেনা। তাঁর শরীরে বাঁধা ছিল একটি গ্রেনেড। চার ইসরাইলি সেনার একজন বলেন, গ্রেনেডে হিব্রু ভাষায় লেখাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি চিনতে পারেন, সেটি ইসরাইলের তৈরি নতুন মডেলের বুলেটপ্রুফ গ্রেনেড।
সেদিন ইসরাইলে পাঁচ হাজার রকেট ছুড়েছিল হামাস। ওই সামরিক ঘাঁটির কয়েক মাইল দূর থেকে একটি রকেট উদ্ধার করে ইসরাইলের একটি ফরেনসিক দল। ইসরাইলের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ফরেনসিক দল পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখে, রকেটে যে বিস্ফোরক ছিল, সে ধরনের বিস্ফোরকের ব্যবহার শুধু সামরিক বাহিনীতেই দেখা যায়। যেটি খুব সম্ভবত এর আগের গাজা যুদ্ধে ছোড়া অবিস্ফোরিত ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
ইসরাইলি পুলিশের বোমা নিষ্ক্রীয়করণ বিভাগের সাবেক উপপ্রধান মিখাইল কারদাশ বলেন, হামাসের হাতে থাকা বিস্ফোরকের প্রধান উৎস হলো অবিস্ফোরিত সমরাস্ত্র। তারা ইসরাইলের ছোড়া বোমা ও কামানের গোলা কাটছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই ব্যবহার করা হচ্ছে। আর অবশ্যই এসব তারা বিস্ফোরক ও রকেট তৈরির ক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছে।
অস্ত্রবিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রায় ১০ শতাংশ বোমা ও গোলাবারুদ অবিস্ফোরিত থেকে যাচ্ছে। যদিও ইসরাইলের দিক থেকে এই হার এর চেয়ে বেশি বলা হচ্ছে। ইসরাইলের অস্ত্রাগারে গত শতকের পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকের অনেক ক্ষেপণাস্ত্র আছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ সামরিক ক্ষমতাধর অন্যান্য দেশ বহুদিন আগে থেকেই এসব ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার বাদ দিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোয়েন্দা তথ্য নিয়ে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসরাইলের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এসব ক্ষেপণাস্ত্র অবিস্ফোরিত থাকার হার ১৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
গাজায় বহু বছর ধরে বিক্ষিপ্তভাবে বোমা হামলা ও সাম্প্রতিক বোমাবর্ষণ যেটাই হোক না কেন, সেখানে হাজার হাজার টন অবিস্ফোরিত সমরাস্ত্র এলোপাতাড়িভাবে পড়ে আছে, যেগুলো পুনরায় ব্যবহারযোগ্য। অবিস্ফোরিত ৭৫০ পাউন্ডের একটি বোমা থেকে কয়েক শ ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট বানানো সম্ভব।
বিস্ফোরক নিয়ে কাজ করে জাতিসংঘের সংস্থা ইউএন মাইন অ্যাকশন সার্ভিস। গাজায় সংস্থাটির প্রধান চার্লস বার্চ বলেন, যুদ্ধের পর গাজায় পড়ে থাকবে কামান, হাতবোমা ও অন্য হাজার হাজার অবিস্ফোরিত সমরাস্ত্র। এগুলো হবে হামাসকে উপহার দিয়ে যাওয়ার মতো একটি বিষয়।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে হামাস নেতৃত্বের কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছিল। তবে হামাস তাতে সাড়া দেয়নি। এদিকে হামাসের অস্ত্রের বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন করা হলেও সেসব প্রশ্নের জবাব দেয়নি ইসরাইলের সামরিক বাহিনী। তারা শুধু বলেছে, তাদের লক্ষ্য এখন হামাসকে নির্মূল করা।