ইউক্রেনে হাতে গোনা কয়েকটি জায়গা আছে, যেখান থেকে খালি চোখে রাশিয়ার দখল করা এলাকা দেখা যায়। খেরসন শহরে নিপ্রো নদীর পশ্চিমাঞ্চলীয় তীর এর একটি। হয়তো নদীর বিপরীত পাশে অবস্থানরত রুশ সেনাদের দেখা যাবে না, কিন্তু তারা যে সেখানে আছে, তা বোঝা যায়।
খেরসনে থাকা বিবিসির একটি প্রতিনিধিদল নিপ্রো নদীর পশ্চিমাঞ্চলীয় তীরে গিয়েছিল। সেখানে পরিত্যক্ত ভবনে অবস্থানকারী ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর ড্রোন পরিচালনাকারী দলের কর্মকাণ্ড সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেছে তারা। সেনারা কীভাবে ড্রোন ওড়াচ্ছেন, কীভাবে শত্রুপক্ষের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করছেন, তা পর্যবেক্ষণ করেছে বিবিসির দলটি।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিনিধিদলটি ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর দেখতে পায়, ইউক্রেনীয় সেনারা কক্ষের ভেতরে সোফায় বসে আছেন। কোনো একটি বিষয়ের দিকে তাদের গভীর মনোযোগ। হঠাৎই ২০ বছর বয়সী ড্রোন পাইলট আরতেম উঠে দাঁড়ান। তাদের কাছে খবর এসেছে, নদীর অপর পার থেকে রুশ বাহিনী ড্রোন উড়িয়েছে।
ইউক্রেনের ১১তম ন্যাশনাল গার্ড ব্রিগেডের সামোসুদ স্কোয়াডের কমান্ডার তিমুর বলেন, “যে জায়গা থেকে ড্রোন ওড়ানো হয়েছে, সেটি আমাদের পরিচিত। পাইলটদের শেষ করে দেওয়াটাই আমাদের লক্ষ্য। আমাদের কাছেও একই ধরনের ব্যবস্থা আছে। আমরা এখনই সেগুলো (ড্রোন) ওড়াচ্ছি।”
মেঝের ওপর অন্তত ১২টি ড্রোন দেখা গেল। সবই গ্রেনেডে ভর্তি। আরতেম তার ভার্চুয়্যাল রিয়্যালিটি হেডসেট পরতে পরতে একটি ড্রোন বাইরে নিয়ে যান। নদীর ওপর দিয়ে ড্রোনটি উড়িয়ে রাশিয়ার দখলকৃত এলাকা অভিমুখে পরিচালিত করতে থাকেন। ড্রোনটি কোথায় কীভাবে যাচ্ছে, তা মনিটরে দেখা যাচ্ছিল।
কয়েক কিলোমিটার ওড়ার পর আরতেমের পাঠানো ড্রোনটি একটি শিল্প এলাকায় পৌঁছায়। একটি গুদাম পেরিয়ে ড্রোনটি কিছু ফ্ল্যাটের কাছে ঘোরাফেরা করতে থাকে। বিবিসির প্রতিনিধিদল যেখানে বসে ছিল, তার মতোই দেখতে ফ্ল্যাটগুলো।
ধীরে ধীরে আরতেম সিঁড়িঘরের জানালার পাশে একটি অ্যানটেনা শনাক্ত করেন। ড্রোনটিকে তিনি ওই অ্যানটেনার দিকে পরিচালিত করেন। টিভির পর্দা তখন নীল হয়ে গেল। আরতেম তখন তার হেডসেটটি খুলে ফেলেন।
আরতেম বলেন, “আমরা প্রথম যখন কাজটি করতাম, তখন তার সঙ্গে আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে থাকত। এখন এটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। আগে (ইউক্রেনে পুরোদমে অভিযান শুরুর আগে) আমি কম্পিউটার গেমস খেলার মতো যথেষ্ট সময় পেতাম না। এখন আমি তা করতে পারছি।”
এরপর আরতেম আরেকটি ড্রোন ওড়ান। তবে ড্রোনটি নদী পার হওয়ামাত্রই টিভি পর্দা নীল হয়ে যায়। ধারণা করা হয়, রুশ কর্তৃপক্ষ তাদের জ্যামিং সিস্টেম (শত্রুপক্ষের রাডার সংকেতে বিঘ্ন সৃষ্টি করার ব্যবস্থা) চালু করেছে।
এরপর একই পথে তৃতীয় ড্রোনটি পাঠানো হয়। ড্রোনটি রুশ–নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আগের সেসব ফ্ল্যাটের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। এবারের ড্রোনটির মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত হন, প্রথম ড্রোনটি যে অ্যানটেনাকে আঘাত করেছিল, সেটি ধ্বংস হয়েছে। এ ড্রোনের ব্যাটারির মেয়াদ ছিল আর ১০ মিনিট। এই ১০ মিনিট সময়ের মধ্যে আর কী কী শনাক্ত করা যায়, কী কী ধ্বংস করা যায়, তা দেখতে থাকেন তিনি।
আরতেমের দলটি একটি প্রধান সড়ককে ড্রোন হামলার লক্ষ্যবস্তু করছে। রুশ বাহিনী এই সড়ককে রসদ সরবরাহের কাজে ব্যবহার করে। ওই সড়কে বেসামরিক নাগরিকদের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ। এ কারণে ইউক্রেনীয় ড্রোন পাইলটরা ওই সড়কে যেকোনো যান দেখলেই নিশ্চিন্তে হামলা চালাতে পারে।
নদীর এই পারে বসে তৃতীয় ড্রোনটি পরিচালনা করতে গিয়ে আরতেম রাশিয়ার একটি তল্লাশিচৌকি শনাক্ত করেন। তিনি এ তল্লাশিচৌকির দিকে ড্রোন ওড়াতে থাকেন। তবে কাছে যেতেই এপারে স্থাপিত টিভি পর্দাটি আবারও নীল হয়ে গেল। রুশ বাহিনী আবারও রাডার সংকেতে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। আরতেমকে আবারও থামতে হয়।
তিমুর বলেন, “আমরা যতবারই একই জায়গায় আঘাত করি না কেন, তারা (রুশ বাহিনী) আবার তা পূর্ণ করে ফেলে। তাদের মধ্যে ভয়ডর নেই।”
প্রতিটি ড্রোন চালানো, নিশানা নির্ধারণ এবং তা ধ্বংস করা একটি ধারাবাহিক কাজ। প্রতিটি ড্রোনের পেছনে খরচ হয় প্রায় ৫০০ ডলার। তবে এ খরচের বিনিময়ে যে ফল পাওয়া যায়, তা তাৎপর্যপূর্ণ।
তিমুর বলেন, ড্রোন ব্যবহার করে তারা শত্রুপক্ষের একটি এস-৩৫০ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা ধ্বংস করেছিলেন। এ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার মূল্য ১৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
ইউক্রেনীয় বাহিনীর দাবি, তাদের ড্রোন যেখানে মোতায়েন থাকে, তার ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে শত্রুপক্ষের কোনো সেনা লুকিয়ে থাকতে পারে না। রুশ বাহিনীও ইউক্রেনীয়দের বিরুদ্ধে একই পদ্ধতি অবলম্বন করছে।
খেরসনের উপকণ্ঠে বরফে আচ্ছাদিত একটি মাঠে পাইলটদের ড্রোন চালানোর অনুশীলন করতে দেখা গেল। অনুশীলনে ব্যবহার করা এসব ড্রোনের নিচে গ্রেনেডের জায়গায় প্লাস্টিকের বোতল বেঁধে রাখা হয়।
সেনারা বলছেন, ড্রোন পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে মাত্র ১৪ ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন। ইউক্রেন সরকার দেশের জনগণকে বিনা মূল্যে এ প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর জন্য বাড়িতে বসে ড্রোন তৈরির ব্যাপারেও উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
ড্রোন কমান্ডার স্টিচ এ যুদ্ধে ড্রোন ব্যবহারের গুরুত্ব কতটা, তা ব্যাখ্যা করেন।
স্টিচ বলেন, “আমরা এখন প্রযুক্তির লড়াইয়ে নিযুক্ত আছি। এটা হলো অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা: কার আগে কে কী উদ্ভাবন করবে, কে বেশি চমৎকার কিছু তৈরি করতে পারবে।”
স্টিচ মনে করেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় উড়োজাহাজের ব্যবহার ছিল, আর এখন হচ্ছে ড্রোন যুদ্ধ। আগামী দুই দশক যেকোনো যুদ্ধের মোড় পাল্টাতে এই ড্রোনই সহায়ক ভূমিকা রাখবে।