মাইকেল কুগেলম্যান যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক। ঢাকা সফররত কুগেলম্যান ইন্দো-প্যাসিফিক ও ভূ-রাজনীতি নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বিজিপ্রেস মিডিয়া এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছে।
ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কোন পর্যায়ে?
মাইকেল কুগেলম্যান: বাংলাদেশ এখন ভূ-রাজনীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছে। বাংলাদেশ সত্যিই এখন সব কিছুর মধ্যে, সব কিছুতে যুক্ত। বর্তমানে বাংলাদেশ নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চলছে। ভারত-চীন প্রতিযোগিতা, যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতা ও যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া প্রতিযোগিতা। আপনারা জানেন, এই তিনটি প্রতিযোগিতাতেই বাংলাদেশ জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি হচ্ছে, কোনো বলয়ে না যাওয়া।
কিন্তু ওই চার দেশ বৈশ্বিক পর্যায়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। বর্তমান অবস্থায় ওই চার দেশের সবার সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা করাই ঢাকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। আমি মনে করি, ভূ-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিকতা আগে কখনো এত স্পষ্ট ছিল না।
বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এত চাপ কেন?
বাইডেন প্রশাসনের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতিই এর মূল কারণ।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতিতেও গণতন্ত্রের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যার ওপর চাপ সৃষ্টির ঝুঁকি নেওয়া যায়। চাপ সৃষ্টি করলে বাংলাদেশের পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। এ জন্য র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ওই নিষেধাজ্ঞার পর বিচারবহির্ভূত হত্যা কমেছে।
এরপর ভিসানীতি আরোপ করেছে। দেখা গেল, এটাও কাজ করছে। রাজনৈতিক সহিংসতা কমেছে। আসলে ভিসানীতির কারণে রাজনীতিবিদরা উদ্বিগ্ন হবেন। কারণ শীর্ষ রাজনীতিকদের অনেকেরই পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয়রা যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। ফলে তাদের কেউ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা না পাওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইবেন না।
আরো অনেক দেশে তো এ ধরনের পরিস্থিতি আছে। সে দেশগুলো নিয়ে তো যুক্তরাষ্ট্র এমন উদ্বেগ দেখায় না। আবার অনেক দেশে নিষেধাজ্ঞা, ভিসানীতি প্রয়োগ করার পরও পরিস্থিতি বদলায়নি। এর পরও বাংলাদেশ কেন?
এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক নীতি সব দেশে সমানভাবে প্রয়োগ করে এমন নয়। বাংলাদেশ ‘টেস্ট কেস’—এমনটি আমি বলতে চাই না। তবে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, চাপ দিলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সাফল্য আসবে। আর এই সাফল্য তারা বাকিদের উদাহরণ হিসেবে দেখাতে পারবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভারত। এ কারণে তারা ভারতের গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে তেমন একটা কথা বলে না। বললেও ততটা চাপ তৈরি করে না।
ভারতের গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, নয়া দিল্লি ওয়াশিংটনের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে নির্বাচন নিয়ে বেশি চাপ দিলে বাংলাদেশ বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকতে পারে। আপনিও কী এমন আশঙ্কা দেখেন?
খুবই কৌতূহলোদ্দীপক ভাবনা। বিষয়টি আসলেই জটিল। ওয়াশিংটন আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপ দিচ্ছে। আর এতে বেইজিংয়ের জন্য ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক আরো উন্নতির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। তাই ওয়াশিংটনের চাপ উল্টো ফল দেয় কি না এমন ভাবনা আসতে পারে।
তবে আমার মনে হয়, আওয়ামী লীগ সরকার চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করবে, কিন্তু ঝুঁকবে না। কারণ এতে ভারত সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। সেই ঝুঁকি আওয়ামী লীগ সম্ভবত নেবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তার বিচার হচ্ছে। এমনকি তাকে ২০ মিনিটের কারাবাসও খাটতে হয়েছে। রিপাবলিকানরা অভিযোগ করেছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করছেন। যুক্তরাষ্ট্র তো বাংলাদেশের মতো দেশে রাজনৈতিক মামলায় বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি আমি সেভাবে অনুসরণ করছি না। তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো খুবই গুরুতর। ইমরান খান, রাহুল গান্ধী বা অন্য কোনো বিরোধী নেতা কারাগারে যান এটি আমি চাই না। এটি আমার ব্যক্তিগত মত।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?
বাংলাদেশ একটি জটিল সময়ের মুখোমুখি। এই পরিস্থিতি অভ্যন্তরীণ ও ভূ-রাজনৈতিক-দুই দিক থেকেই। অভ্যন্তরীণ জটিলতা হলো, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এ দেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
এখানে অনেক প্রশ্ন আছে। যেমন-বিরোধীরা নির্বাচন কীভাবে মোকাবেলা করবে? তারা কি নির্বাচন বর্জন করবে? অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেক চাপ আছে। তাই অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে এটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ সময়।
আমার মনে হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আগামী দিনগুলোতে কী হতে যাচ্ছে তা এখন খুবই অস্পষ্ট।
কিন্তু বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্ভবত অনিশ্চিত নয়। এটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ হবে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে যাবে। কারণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে ওই দেশগুলোর সম্পর্ক ভালো।
আমার ধারণা, ভবিষ্যতেও বড় শক্তিগুলোর মধ্যে বৈরিতা শেষ হবে না। বাস্তবে বৈরিতা আরো বাড়তে পারে। এর অর্থ ওই চার বড় শক্তির সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে ঢাকা আরো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়বে।
বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গি কেমন মনে হচ্ছে?
মাইকেল কুগেলম্যান: সম্প্রতি বাংলাদেশ তার ইন্দো-প্যাসিফিক ভাবনা ডকুমেন্ট আকারে প্রকাশ করে সামনে এগিয়ে এসেছে। এটি সত্যিই তাৎপর্যপূর্ণ। এর বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত, আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক ডকুমেন্ট যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রত্যাশার মধ্যে একটা ভারসাম্যের নমুনা। যুক্তরাষ্ট্র যা দেখতে চায় এবং চীন যা দেখতে চায় তার সমন্বয় করা হয়েছে এখানে।
বাংলাদেশ তার ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে শৃঙ্খলাভিত্তিক উন্মুক্ত ব্যবস্থার মতো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কিছু মৌলিক বিষয় রেখেছে। আবার একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার মতো এমন কিছু বিষয় রেখেছে, যা চীনের অবস্থানের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
আমি এও বলব যে বাংলাদেশ যা প্রকাশ করেছে তা ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গি। এটি নীতি নয়। দৃষ্টিভঙ্গি কৌশলগত নথি বা অনানুষ্ঠানিক কোনো ডকুমেন্ট। আমার মনে হয়, এটিও বেইজিংকে একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা। বার্তাটি হলো, বাংলাদেশের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র ও শরিকদের অবস্থানের সঙ্গে একেবারে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়।
ব্রিকসের প্রথম পর্যায়ের সম্প্রসারণে বাংলাদেশ নেই। সরকার দাবি করেছে, তারা সদস্য হওয়ার জন্য তেমনভাবে চায়ওনি। বাংলাদেশ চেয়েছে নতুন উন্নয়ন ব্যাংকে (এনডিবি) থাকতে। সেটা তারা পেরেছে। এই জোট এবং ছয় দেশ নিয়ে নতুন সম্প্রসারণকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মাইকেল কুগেলম্যান: ব্রিকস সম্প্রসারণ উদ্যোগে বড় বিজয়ী ভারত। নতুন সদস্যদের বেশির ভাগ পশ্চিমাবিরোধী নয়। এর অর্থ ব্রিকস পশ্চিমাবিরোধী জোট হবে না। ভারত এটি চেয়েছে। এ ছাড়া নতুন সদস্যদের মধ্যে মিশর, সৌদি আবর, সংযুক্ত আরব আমিরাত—এই তিন দেশ ভারতের শীর্ষ অংশীদার।
বাংলাদেশ ব্রিকসের অর্থনৈতিক উদ্যোগের সঙ্গে আছে। এই জোট আগামী দিনে আরো সম্প্রসারিত হওয়া উচিত।