সালমান এফ রহমান যদি বোরকা পরে পালাতে চেষ্টা করতেন, তাহলেও আমার পক্ষে মেনে নেয়া কষ্টকর হতো না। কিন্তু বাংলাদেশের শীর্ষ ধনবানদের অন্যতম (যদিও তার কোম্পানিগুলোর ব্যাংকঋণের পরিমাণ আনুমানিক ৫০ হাজার কোটি টাকা) এবং রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করা ব্যক্তি সালমান এফ রহমান দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে পলায়নপর হবেন, এটা মেনে নেয়া কঠিন। দাড়ির এমন অপমান সহ্য করা যায় না। কম করে হলেও ৪০ বছর যাবত আমি তার দাড়ির সঙ্গে পরিচিত। তার কালো দাড়ির ভিড়ে দু’চারটে শুভ্র হয়ে উঠা দাড়ির সময় থেকে তাকে জানি। কালক্রমে তার দাড়ি ও গোঁফের তুষার ধবল শ্বেত-শুভ্র হওয়া কেবল আমি নই, সকলেই প্রত্যক্ষ করেছেন।
কালক্রমে তিনি আন্দালিব রহমান পার্থের ভাষায় “দরবেশ বাবা’য় পরিণত হয়েছিলেন। উপমহাদেশে যারা দরবেশ, পীর ও সাধু-সন্ত তারা মৌনতায় বিশ্বাস করেন। কারও সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হন না। কিন্তু দরবেশ সালমান এফ রহমান ভিন্ন ধরনের দরবেশ ছিলেন। কেউ তাকে নিয়ে অথবা তার ব্যবসার গোমর ফাঁস করার চেষ্টা করলেই তিনি চরম উষ্মা প্রকাশ করতেন এবং তার এই প্রকাশ ঘটতো সংসদে, আনুষ্ঠানিক বৈঠকে, এমনকি টেলিভিশন টকশো’তে।
সম্ভবত দাড়ির কারণে তিনি এক ধরনের ইসলামী প্রবক্তাও হয়ে উঠেছিলেন। একদিন কোথাও এক মসজিদে তিনি নামাজে ইমামতি করেন। আরেকদিন তাকে বলতে শুনি “হাদিসে তো অনেক সমস্যা. কোরআনেও কিছু সমস্যা আছে।” বাপরে বাপ কত বড় বুযুর্গানে দ্বীন! ক্ষমতাধরদের সামনে আলেমে দ্বীনদের মুখে কুলুপ এটে থাকা নতুন কিছু নয়। এমনটি যুগে যুগে ঘটেছে বলেই মোগল সম্রাট আকবর এক ধরনের আলেমের সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন ধর্ম “দ্বীন-ই-ইলাহি” চালু করতে পেরেছিলেন। আকবরের ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’র বিরুদ্ধে লড়তে আবির্ভাব ঘটেছিল মুজাদ্দিদ আলফিসানির। দরবেশ সালমান এফ রহমান সবে ধরা পড়লেন। দেশবাসী নিশ্চয়ই তার কারামত দেখতে পাবে।
সালমান এফ রহমানের দাড়ি মুন্ডন এর কারণ সকলেই বুঝতে পারেন। গ্রেফতার এড়ানো। কিন্তু তার প্রচেষ্টা সফল হলো না, মাঝখান থেকে তার দীর্ঘদিনের লালিত দাড়িও গেল। আল্লাহর শোকর যে তিনি আইনশৃংখলা রক্ষাকারীদের হাতে পড়েছিলেন। সেজন্য সহি সালামতে আছেন। জনতার হাতে ধরা পড়লে কি হতো তা আলিমুল গায়েবই জানেন।
দাড়ি মুণ্ডন করেও অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা পাওয়া যায় না। ১৯৮৪ সালে খালিস্তান আন্দোলনকে দমন করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানে শিখদের পবিত্র স্থান অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির ধ্বংস হয়েছিল। নিহত হয়েছিল প্রায় ৫ হাজার শিখ। জুন মাসের এ ঘটনার পাঁচ মাস পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করে তার শিখ দেহরক্ষীরা। এর পরিণতিতে ভারতজুড়ে, বিশেষ করে দিল্লিতে শিখদের ওপর চালানো হয় হত্যাযজ্ঞ। শিখরা তাদের দীর্ঘ চুল খাটো করা ও লম্বিত দাড়ি চেছে ফেলার প্রতিযোগিতায় নামে। কিন্তু দাড়ি মুন্ডন করেও তারা রক্ষা পায়নি। সরকারি হিসাবে নিহত হয় ৩,৩৫০ জন শিখ। বেসরকারি হিসাবে নিহত শিখ সংখ্যা ৮ থেকে ১৬ হাজারের মধ্যে।
২০০১ সালে নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর বহু মুসলিম ও শিখ দাড়ি মুন্ডন করেছিল বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। জান বাঁচানো ফরজ। দাড়ির মায়া কে করে? জান গেলে জান ফিরে পাওয়া যাবে না। কদিন অপেক্ষা করলেই সাই সাই করে দাড়ি লম্বা হয়ে যাবে।
কিন্তু সালমান এফ রহমানের জীবন সংশয় ঘটেনি। দাড়ি না চেছে পালানোর চেষ্টা করলেই পারতেন; অথবা আত্মসমর্পণ করতে পারতেন। তার দাড়িগুলো সুন্দর ও আকর্ষণীয় ছিল। কিন্তু মাকুন্দা দরবেশের ছবি আদৌ ভালো লাগছে না।
দাড়ির কারণে তিনি যে “দরবেশ বাবা” খ্যাতি লাভ করেছিলেন, দাড়ি মুন্ডন করে তিনি তার খ্যাতি নাশ করেছেন।
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু: বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক, আমেরিকা প্রবাসী