ঢাকা: সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদানের জন্য এবিএম মূসা-সেতারা মূসা আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক। বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এবিএম মূসা-সেতারা মূসা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এম এ মালেকের হাতে এই সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে ‘গণমাধ্যমে জেন্ডার পরিসর: নারীর নির্মিত এবং নারীর অংশগ্রহণ’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা করেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন।
দৈনিক আজকের পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক ড. গোলাম রহমানের সভাপতিত্বে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য তুলে ধরেন এবিএম মূসার কন্যা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শারমিন মূসা। অনুষ্ঠানে মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম, ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম, লেখক ও শিক্ষক কু?ররাতুল-আইন-তাহ্?মিনা, নিউজ ২৪ টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদুল্লাহ রিপন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এসএম শামীম রেজা, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু, দৈনিক বাংলার চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ ডেইজি মওদুদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। আজীবন সম্মাননা দিতে গিয়ে এম এ মালেককে উত্তরীয় পরিয়ে দেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও এবিএম মূসার বড় মেয়ে মরিয়ম সুলতানা মূসা রুমা। সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও মেজো মেয়ে পারভীন সুলতানা মূসা ঝুমা।
সম্মাননা প্রাপ্তির প্রতিক্রিয়ায় এম এ মালেক বলেন, সত্য বলতে আমরা বুঝি কোনো কিছুর যথাযথ প্রকাশকেই। কথাটি বলতে যত সহজ, বাস্তবে এই পথ ততটাই কঠিন। পদে পদে আপনাকে বহু বাধার সম্মুখীন হতে হবে। একজন সাংবাদিকের এসব বাধা পার হয়ে যাওয়ার মানসিকতা থাকতে হয়, সাহস থাকতে হয়। এবিএম মূসার সেই সাহস ছিল। তিনি অকপটে সত্যকে তুলে ধরেছেন। কোনো অবস্থাতেই মানবিক মূল্যবোধকে বিসর্জন দেননি। এ কারণেই তিনি আমাদের কাছে অনুকরণীয়, বরণীয়। তার নামাঙ্কিত পুরস্কার পেয়ে আমি সত্যিই গৌরব বোধ করছি। এ পুরস্কার আমার জীবনের অন্যতম অহংকার হিসেবে থাকবে।
তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে সাংবাদিকদের জন্য অনেক বেড়াজাল তৈরি করা হয়েছিল। ছিল শাসকের রক্তচক্ষু। সাংবাদিকদের পেশাগত কাজ সম্পর্কে অনেক ফরমান জারি করা হতো। একটু এদিক-ওদিক হলেই করা হতো মামলা, জেল-জুলুম। কিন্তু এসব বেড়াজালের ফাঁক-ফোকর দিয়েও এবিএম মূসা সত্য কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। তার সেই প্রচেষ্টা সাংবাদিকতার ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। যে সাংবাদিকতা মানুষের মধ্যে শুভবোধের সঞ্চার করে, যা বিবেককে জাগ্রত করে, সত্যকে নির্মোহভাবে উপস্থাপিত করে- এবিএম মূসা সে পথেই হেঁটেছেন।
এম এ মালেক বলেন, সংবাদপত্র এমনই এক স্বপ্ন, যা আমরা সমবেতভাবে দেখি দিনের পর দিন। এ স্বপ্নপূরণের প্রধান শর্তই হচ্ছে আপনাকে সত্যনিষ্ঠ থাকতে হবে। অনেকে বলেন-বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা। আমি এটা বলি না। কারণ বস্তুর ভাষা নেই, মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। সত্যনিষ্ঠ হওয়া মানে সত্য কঠিন হলেও আপনি তা থেকে বিচ্যুত হতে পারেন না।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান বলেন, এবিএম মূসা যতটা ভালো বলতেন, তার থেকে ভালো লিখতেন। তার লেখাগুলো অসাধারণ ছিল। কলামের লেখাগুলো মুগ্ধ হয়ে পড়তাম। তিনি শুধু গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতার ছিলেন তা নয়, তিনি রাজনৈতিক জায়গায়ও ছিলেন পারদর্শী। আমরা আজকের কথাগুলো যদি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারি, জাতি ভালো কিছু পাবে।
স্মারক বক্তৃতায় ড. কাবেরী গায়েন বলেন, প্রিন্ট মিডিয়া অনেক বেশি পুরুষতান্ত্রিক। নারীর ইমেজ নির্মাণে প্রিন্ট মিডিয়া অনেক সূক্ষ্ম কৌশলীও। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্রগুলো মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতার দিকে ঝুঁকছে। সেখানে নারীর প্রতি সহিংসতার ভিন্নমাত্রা যুক্ত হয়েছে পাঠকের মন্তব্য ঘরে। যুক্ত হয়েছে অনলাইন পোর্টাল নামের বিভীষিকাময় ক্লিক-বেইট সাংবাদিকতা, যা অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে ধরাশায়ী করার উপায় ও উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যমে নারীর উপস্থিতি বেড়েছে। কিন্তু এখনো গুরুত্বপূর্ণ বিটে নারীরা নেই, যাতায়াত সুযোগ নেই, মাতৃত্বকালীন ছুটিতে বাধা, সংবাদকক্ষে রাজনীতির শিকার, সহকর্মীর কাছে যৌন হয়রানির শিকার হওয়াসহ নানারকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়।
মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, আমাদের সবক্ষেত্রে তথ্যের অভাব, গবেষণার অভাব। যে তথ্যগুলো এসেছে সেগুলো অনেক পুরোনো। খুব বেশি তথ্য ছাড়া কথা বলা যায় না। আজকের নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা যোগ্যতায়, এগিয়ে এসেছে। সমাজ রাষ্ট্র সবসময় সহায়ক হিসেবে থাকছে না।
সংবাদ পণ্যে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম বলেন, মার্কেট ইকোনমির কারণে সংবাদ পণ্যে পরিণত হয়েছে। তাই সংবাদপত্রের মালিকানার বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে। বর্তমানে সাংবাদিক ও শিক্ষক দুই ভাগে বিভক্ত। কেউ আওয়ামী লীগের শিক্ষক ও সাংবাদিক, কেউ বিএনপি’র। এটা হয়তো সাময়িক ফল বয়ে আনতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যতে এটা পুরো জাতির জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠবে।
সাংবাদিক, লেখক ও অধ্যাপক কুররাতুল-আইন-তাহমিনা বলেন, সংবাদে নারীর উপস্থিতি আমি দেখতে চাই। প্রত্যেক জায়গায় অন্তত একটা নারীর কণ্ঠস্বর শুনতে চাই। ট্রান্সজেন্ডারের প্রসঙ্গ একেবারেই খুবই অবহেলিত। সহিংসতার খবর আসে পত্রিকায় এই নিয়ে আমাদের এমন ধারণা যেন না হয় এটা নিয়ে আসার প্রয়োজন নেই। খবরই যদি বন্ধ হয়ে যায় কীভাবে চলবে। তবে খবরটা কীভাবে আসে, কীভাবে উপস্থাপিত হয় সেটা বড় বিষয়।
শাহানাজ মুন্নি বলেন, আমি নারী সাংবাদিকতার উত্থান-পতন দেখছি। কখনো খুব আশাবাদী হচ্ছি, আবার কখনো হতাশায় ভেঙে পড়ছি। নারী সাংবাদিকতায় অনেকে টিকে আছেন আবার অনেকে ঝরে পড়ছেন। অনেক নারী সাংবাদিক কর্মরত আছেন। তবে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বিবেচনা করে দেখা যায় এক তৃতীয় অংশেরও কম নারী সাংবাদিক গণমাধ্যমে কর্মরত আছেন। একটা দিব্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন দরকার। নারী অবস্থান পরিবর্তনের জন্য শুধুমাত্র নারীদের বিষয় নয়, এটা সমাজের প্রত্যেককে চাইতে হবে।
পালাবদল/এসএ