নয়া দিল্লি: বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত তিনটি সরকারের আমলে যে দেশটির সঙ্গে তারা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছে এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে যারা সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, সে দেশটি নিঃসন্দেহে ভারত। প্রধানমন্ত্রী হাসিনার নতুন মেয়াদেও সেই ধারা বজায় থাকার সম্ভাবনা ষোলো আনা।
অন্য দিকে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতেও বাংলাদেশের গুরুত্ব বিগত দেড় দশকে ক্রমশ বেড়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবেও ভারত একাধিকবার বলেছে, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশই তাদের ‘সব চেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী’। এই মন্তব্য করার সময় ভুটানকে হয়তো হিসেবের বাইরে রাখা হয়েছে, কারণ দিল্লি ও থিম্পুর সম্পর্কের রসায়নটা আলাদা -নানা কারণে ভুটানের পরিস্থিতিও সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এই সময়কালে নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, কানেক্টিভিটি বা সংযোগ, অভিন্ন নদীগুলোর পানিবন্টন, স্থল ও সমুদ্র সীমায় বিরোধ নিরসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা ইত্যাদি বিভিন্ন ইস্যুতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনায় অভাবনীয় অগ্রগতিও লক্ষ্য করা গেছে। তবে এর মধ্যে সবগুলো ইস্যুরই যে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে তা বলা যাবে না। সীমান্ত বিরোধ মিটলেও সীমান্তে হত্যা নিয়ে অস্বস্তি যেমন রয়েই গিয়েছে, তেমনি আবার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও তিস্তা চুক্তির জট এখনও খোলা যায়নি।
আর এই পটভূমিতেই আজ বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দিল্লিতে এসেছেন বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই বিদেশে তার প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর-যেখানে তিনি বৈঠকে বসবেন তার ভারতীয় কাউন্টারপার্ট এস জয়শঙ্করের সঙ্গে। দু’দেশের আলোচনার বিষয়বস্তু বা এজেন্ডাতে পরিবর্তন আসবে সেটাই প্রত্যাশিত -কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোনও কোনও ইস্যু হয়তো বেশি গুরুত্ব দাবি করবে, কোনও কোনও বিষয়ে দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছনোর প্রয়োজন হবে।
আগামী পাঁচ বছরে সেই প্রধান ইস্যুগুলো কী কী হতে পারে, সেটা নিয়ে বিবিসি দিল্লি ব্যুরো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আজ। বিবিসি কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেছে। এগুলো হলো: গঙ্গা চুক্তির নবায়ন, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম, শেখ হাসিনার পর কে?
এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম
যে জটিল সমস্যা বা কঠিন পরিস্থিতির কথা সবাই জানে, অথচ চট করে বা প্রকাশ্যে সেটা নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না – সেই অবস্থাটা বোঝাতে ইংরেজিতে ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’-এই ফ্রেজ বা শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা হয়।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেও এরকমই একটা ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’ আছে। এবং সেটা আর কিছুই নয় -চীন ফ্যাক্টর।
বস্তুত ঘরের পাশে বাংলাদেশে চীন কতটা আর কীভাবে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে, অথবা বেইজিং কীভাবে ঢাকাকে কাছে টানার চেষ্টা করছে সে দিকে ভারত সব সময় সতর্ক নজর রাখে। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে প্রকাশ্যে কখনোই মন্তব্য করা হয় না।
উল্টোদিকে বাংলাদেশও প্রকাশ্যে অন্তত সব সময়ই চীন ও ভারতের মধ্যে একটা ‘ভারসাম্যের কূটনীতি’ বজায় রাখার চেষ্টা করে চলে। কিন্তু ঢাকা ও দিল্লির সম্পর্কের মধ্যে চীন ফ্যাক্টর কোনোভাবে ছায়াপাত করছে, এটা তারাও স্বীকার করতে চান না।
তবে অতি সম্প্রতি যেভাবে বাংলাদেশে তিস্তা বহুমুখী প্রকল্প নির্মাণে চীনের আগ্রহ থাকলেও তাতে ভারতের আপত্তির কথা প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে আগামী দিনেও ঢাকা-দিল্লির আলোচনায় চীন প্রসঙ্গ বারে বারেই আসবে।
তিস্তার ওপর বাংলাদেশে একটি বহুমুখী ব্যারাজ প্রকল্প নির্মাণে তাদের আগ্রহের কথা চীনা রাষ্ট্রদূত ঘোষণা করেছিলেন প্রকাশ্যেই। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ঠিক পর পরই চীন এই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চাইলেও ভারত বাদ সেধেছে বলেই সে প্রক্রিয়া আপাতত থমকে আছে।
ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির ঘনিষ্ঠ ফরেন পলিসি এক্সপার্ট শুভ্রকমল দত্তর কথায়, “বাংলাদেশকে যে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেই চলতে হবে এটা ভারত খুব ভারেঅভাবেই উপলব্ধি করে। চীনের মুখের ওপর সব দরজা বন্ধ করতে দিতে হবে, এ কথা কেউ বলছেও না। কিন্তু বাংলাদেশে যদি চীন এমন কিছু করতে যায় যেটা ভারতের স্ট্র্যাটেজিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থকে সরাসরি হুমকিতে ফেলবে, ভারত অবশ্যই সেটা অ্যাড্রেস করতে চাইবে।”
বস্তুত চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগীও বটে। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে চীন থেকেই, ভারতের তুলনায় যে পরিমাণ অন্তত আড়াই গুণ।
প্রতিরক্ষা খাতেও বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সামরিক সরঞ্জাম কেনে চীনের কাছ থেকেই। বছর কয়েক আগে বাংলাদেশ নৌবাহিনী চীনের কাছ থেকে দুটি ডুবোজাহাজ বা সাবমেরিনও পেয়েছিল, যা ভারতকে তখন বেশ বিচলিত করে। সে সময় ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিক্কর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকায় ছুটে গিয়েছিলেন।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে (যাতে ভারতও আছে) বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে অতি সম্প্রতিও আন্তর্জাতিক স্তরে কূটনৈতিক তৎপরতা দেখা গেছে। অন্য দিকে বাংলাদেশ ‘কোয়াড’ জোটে ভিড়লে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হবে, প্রকাশ্যেই এ ধরনের প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি এসেছে চীনের কাছ থেকে। এই পরিস্থিতিতে তথাকথিত ‘চীন ফ্যাক্টর’ যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে আগামীতে আরো প্রবলভাবে ছায়াপাত করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শুভ্রকমল দত্ত মনে করছেন, এখানে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
প্রথমত মালদ্বীপের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলছেন, সম্প্রতি ভারত মহাসাগরের ওই দ্বীপপুঞ্জে যেভাবে ভারত-বিরোধী সেন্টিমেন্টে ভর করে একটি চীন-পন্থী সরকার ক্ষমতায় এসেছে ভারত কিছুতেই চাইবে না বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি হোক। ফলে বাংলাদেশের মাটিতে চীনের রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক প্রভাব খর্ব করার একটা চেষ্টা ভারতের দিক থেকে থাকবেই।
দ্বিতীয়ত, ভারত এটা বিশ্বাস করে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুতেই বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ভারত-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করতে দেবেন না। ফলে চীন যতই চেষ্টা করুক, বাংলাদেশকে তারা ভারতের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারবে না।
শুভ্রকমল দত্ত এটাও জানাচ্ছেন, তার সদ্যগঠিত মন্ত্রিসভায় শেখ হাসিনা ‘প্রচ্ছন্নভাবে চীনপন্থী’ কয়েকজন হেভিওয়েট নেতাকে বাদ দিয়েছেন বলেই ভারত মনে করে -যে পদক্ষেপকে তারা অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে।
তৃতীয়ত, দেশটা যখন বাংলাদেশ -তখন সেখানে চীনের তুলনায় ভারতের সব সময় একটা ‘সাংস্কৃতিক অ্যাডভান্টেজ’ থাকবে বলেই ড. দত্তর ধারণা।
“আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক শুধু ঐতিহাসিকই নয়, এই দুই দেশের পিপল-টু-পিপল কনট্যাক্ট বা মানুষে মানুষে আদানপ্রদানও অনেক বেশি জোরালো। চীন সেটা কখনোই গড়ে তুলতে পারবে না, আর এখানে ভারত চিরকাল অনেক বেশি এগিয়ে থাকবে”, আত্মবিশ্বাসী সুরে জানাচ্ছেন শুভ্রকমল দত্ত।