অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক রিচার্ড স্কোলিয়ার ও জর্জিনা লং দীর্ঘদিনের বন্ধু। দুজনই ত্বকের ক্যানসারের সামনের সারিতে থাকা চিকিৎসক। গত বছরের জুনে স্কোলিয়ারের নিজের মস্তিষ্কের স্ক্যান-সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর দুজনই থমকে যান। স্ক্যান রিপোর্টে দেখা যায়, অধ্যাপক রিচার্ড স্কোলিয়ারের খুলির ডান দিকের কোনায় ওপরের দিকের অংশটি অন্যান্য অংশের থেকে তুলনায় অন্ধকার। দুজনের মনে আশঙ্কা দানা বাঁধতে থাকে।
বিবিসিকে স্কোলিয়ার বলেন, “আমি রেডিওলজি বিশেষজ্ঞ নই। তবে আমার মনে হচ্ছিল, এটা টিউমার।”
এরপর নিউরোসার্জনকে দেখানো হলো। তারা আরও ভীতিকর তথ্য দিলেন। বললেন, এটা শুধু মস্তিষ্কের টিউমারই নয়, আরও ভয়ংকর কিছু। এটি একধরনের গ্লায়োব্লাস্টোমা (মস্তিষ্কের একধরনের ক্যানসার)। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই এক বছরের কম সময়ের মধ্যে মারা যায়। গত জুনে ছুটিতে পোল্যান্ডে গিয়েছিলেন স্কোলিয়ার। সেখানে খিঁচুনি হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের ওই স্ক্যান করিয়েছিলেন তিনি।
এখন স্কোলিয়ার ও লং এক অসাধ্যসাধনে ব্রত হয়েছেন। কীভাবে এ রোগের চিকিৎসাপদ্ধতি বের করে স্কোলিয়ারের জীবন বাঁচানো যাবে, সে চেষ্টা শুরু করেন তারা। দুই অস্ট্রেলীয় চিকিৎসকের এই চেষ্টা নতুন নয়। এর আগেও তারা একটি অসাধ্য কাজ করে দেখিয়েছেন। চতুর্থ ধাপের (অ্যাডভান্সড) ত্বকের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় সাফল্য দেখিয়েছেন তারা।
অধ্যাপক স্কোলিয়ার বলেন, “চেষ্টা না করে এমনি এমনি মৃত্যুকে নিশ্চিত বলে মেনে নেওয়াটা আমার সঙ্গে যায় না। এটা দুরারোগ্য ক্যানসার? ঠিক আছে, ঠেকানোর চেষ্টা করা যাক!”
স্কোলিয়ার ও লং নামের দুই চিকিৎসকবন্ধুর প্রথম পরিচয় ৩০ বছর আগে। তখন তারা তরুণ চিকিৎসক। ওই সময় অস্ট্রেলিয়ায় চতুর্থ ধাপের (অ্যাডভান্সড) ত্বকের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার অপর নাম ছিল মৃত্যু।
ইমিউনোথেরাপির ব্যবহার
একসময় বিশ্বে ত্বকের ক্যানসারে সর্বোচ্চ আক্রান্তের হার ছিল অস্ট্রেলিয়ায়। ত্বকের ক্যানসারের চিকিৎসাকে ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ মনে করা হতো। তবে স্কোলিয়ার ও লং এ ক্ষেত্রে আশার আলো দেখান। তারা দুজন এখন অস্ট্রেলিয়ার অলাভজনক প্রতিষ্ঠান মেলানোমা ইনস্টিটিউটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিশ্বজুড়ে ত্বকের ক্যানসারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে সুফল আসছে, তাতে অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছে মেলানোমা ইনস্টিটিউট।
দশক ধরে এই দুই চিকিৎসকের নেতৃত্বাধীন গবেষণায় দেখা গেছে, ইমিউনোথেরাপি ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে শেষ ধাপের ত্বকের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ক্যানসার কোষকে আক্রমণ করতে রোগীর শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে এ চিকিৎসায় ৫০ শতাংশ রোগী সুস্থ হচ্ছেন। আগে সুস্থ হওয়ার হার ১০-এর কম ছিল।
মস্তিষ্কের কানেকটিভ কোষে গ্লায়োব্লাস্টোমার বিষয়টি ভয়ংকর। রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি দিয়ে দুই দশক ধরে এর চিকিৎসা চলছে। তবে তাতে সামান্যই পরিবর্তন দেখা যায়। বেঁচে থাকার হার একই থাকতে দেখা গেছে। মাত্র ৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে ৫ বছরের বেশি বাঁচতে দেখা গেছে।
চিকিৎসক লং চাইছেন, যে পদ্ধতিতে তারা ত্বকের ক্যানসারের চিকিৎসা করছেন সেই একই পদ্ধতিতে স্কোলিয়ারের চিকিৎসা করতে। তবে এর আগে মস্তিষ্কের ক্যানসারের চিকিৎসায় এ পদ্ধতি কখনো ব্যবহার করা হয়নি।
ত্বকের ক্যানসারের ক্ষেত্রে চিকিৎসক লং এবং তার দলের গবেষণায় দেখা গেছে, ওষুধের মিশ্রণ তৈরি করে ব্যবহার করা হলে ইমিউনোথেরাপি অপেক্ষাকৃত বেশি কাজ করে। এ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করে টিউমার অপসারণের আগে ইমিউনোথেরাপি দিতে হয়।
ঝুঁকিও আছে অনেক
ক্যানসার-বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ স্কোলায়ার মস্তিষ্কে আদৌ ওষুধ পৌঁছাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। যদি তা হয়ও, তারপরও রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা সাড়া দেবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তারা। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, পরীক্ষা চালাতে গিয়ে হয়তো সময়ের আগেই প্রাণ হারাতে পারেন স্কোলায়ার।
ক্যানসার-বিশেষজ্ঞরা বলেন, মস্তিষ্কের ক্যানসার এতটাই দ্রুত ছড়ায় যে অস্ত্রোপচারে দুই সপ্তাহ দেরি হয়ে গেলেই অনেক দেরি হয়ে যায়। ইমিউনোথেরাপির জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তা সম্পূর্ণ বিষাক্ত, বিশেষ করে যখন এর মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এগুলোর কারণে তার মস্তিষ্কের আকার যদি বড় হয়ে যায়, তবে তার দ্রুত মৃত্যু ঘটতে পারে।
চিকিৎসক স্কোলিয়ার হলেন মস্তিষ্কের ক্যানসারে আক্রান্ত প্রথম রোগী, যাকে অস্ত্রোপচারের আগেই ইমিউনোথেরাপি দেওয়া হয়েছে।
কয়েক সপ্তাহ পর স্কোলিয়ার মস্তিষ্কের সে টিউমার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুধু টিউমারেই যে ওষুধ পৌঁছেছে তা নয়, মস্তিষ্কেও যে ওষুধ পৌঁছেছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেখানে রোগপ্রতিরোধী কোষগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গবেষক দলের আশা, রোগপ্রতিরোধী কোষগুলো সক্রিয় হয়ে ক্যানসার কোষগুলোকে আক্রমণ করছে।
সাধারণত অস্ত্রোপচারের ছয় মাস পর গ্লায়োব্লাস্টোমা ক্যানসার ফিরে আসে। তবে একটানা ইমিউনোথেরাপির নেওয়ার আট মাসেও স্কোলিয়ার শরীরের ক্যানসারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
গত সপ্তাহেও মস্তিষ্কের এক স্ক্যানে কিছু ধরা পড়েনি। চিকিৎসক লং বলেছেন, স্কোলিয়ার মস্তিষ্ক স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। এমন ফলাফলের কারণে স্কোলিয়ার জীবন দীর্ঘায়িত হওয়ার আশা করা হচ্ছে।
মরতে চান না স্কোলিয়ার
এ ধরনের গবেষণায় কয়েক বছর, এমনকি কয়েক দশকও লেগে যায়। তবে স্কোলিয়ার ও লং মাত্র কয়েক মাসেই ফল পেতে শুরু করেছেন। এতে অনেক ওষুধ কোম্পানি তাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে।
চিকিৎসক স্কোলিয়ারের আশা, “অলৌকিক কিছু ঘটতে পারে।” তিনি মনে করেন, এখন পর্যন্ত যে বেঁচে আছেন, সেটা বাড়তি পাওয়া। এর আগেও মরে যেতে পারতাম।”
গত ডিসেম্বরে ৫৭তম জন্মদিন উদ্যাপন করেছেন স্কোলিয়ার। স্ত্রী ক্যাথি, সন্তান এমিলি, ম্যাথিউ ও লুসির সঙ্গে আরেকটি বড়দিন উদ্যাপন করেছেন। তিনি বলেন, “আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি। স্ত্রীকে ভালোবাসি। আমি আমার কাজ ভালোবাসি।”
তবে চিকিৎসার ব্যাপারে আশাবাদী হলেও স্কোলিয়ার বলেছেন, তিনি মনের মধ্যে এক শঙ্কা বয়ে বেড়াচ্ছেন। বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি মরতে চাই না।”
তবে এ চিকিৎসকের মনের মধ্যে একটা তৃপ্তিও আছে। তিনি মনে করেন, মৃত্যু হলেও এ গবেষণার মধ্য দিয়ে তারা যে তথ্যগুলো পেয়েছেন, সেগুলো পরবর্তী সময়ে চিকিৎসাজগতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।