‘ভূমণ্ডলের দীপ্যতম সুরগন্ধর্ব’- ঋতুপর্ণ ঘোষ মন্তব্য করেছিলেন উস্তাদ রশিদ খান সম্পর্কে। প্রথম বার তার গান শুনে ভীমসেন জোশী বলেছিলেন, ‘‘ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তার ভবিষ্যৎ পেয়ে গিয়েছে।’’ সেই ‘ভবিষ্যৎ’ই অকালে অতীত হয়ে গেলেন ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে।
ঐশ্বর্যমণ্ডিত কণ্ঠের জাদুতে যিনি মাত করেছেন শ্রোতার হৃদয়, তার প্রয়াণকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে অপরিমেয় ক্ষতি বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। উস্তাদ রশিদ খানের প্রয়াণে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সেই ‘সোনার কণ্ঠ’ এখন অতীতকাল, ঘটমান বর্তমান নয়। গান শুরু করার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি কোথায় যেন হারিয়ে যেতেন, প্রত্যক্ষ করেছেন তার সঙ্গে সঙ্গত করা সহশিল্পীরা। আর শ্রোতারা? তারাও তো সেই কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে যেতেন লহমায়।
গানবাজনার একটা দিক যদি হয় ‘রিয়াজ’ অর্থাৎ অনুশীলন, তবে অন্য দিক হলো আবেগ। এক সাক্ষাৎকারে রশিদ এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘জীবনের যে ছোট ছোট দুঃখ, অপ্রাপ্তি-সেই সব রং আমি গানের মধ্যে আনার চেষ্টা করি।’’ সেই চেষ্টা করেছেন বলেই হয়তো তিনি গলা মেললেই শ্রোতারা বলে উঠতেন ‘‘আহা!’’ তিনি গলা মেললে তৈরি হতো কিছু অলৌকিক মুহূর্ত। যে কারণে হয়তো ঋতুপর্ণ তার ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ ছবির শেষ দৃশ্যে রশিদের কণ্ঠ ব্যবহার করার কথা ভেবেছিলেন। কী ছিল সেই দৃশ্যে? স্মৃতিভার ফিরে ফিরে আসছে মৃত্যুপথযাত্রী অমিতাভ বচ্চনের। কিছু মনে পড়ছে, কিছু পড়ছে না। আবহে সেই ঐশ্বরিক কণ্ঠে মিশ্র পিলু-মিশ্র বরোয়াঁ রাগে উত্তুঙ্গ আলাপ। যে আলাপ শেষে শুরু হবে রশিদের কণ্ঠে ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার…’।
তার গানে যেমন বোলতানের ছায়া পাওয়া যেত, তেমনই ছিল ছোট ছোট সরগমের কারুকাজ। সঙ্গে উল্লেখযোগ্য স্থান পেয়েছে ‘তারানা’।
তার গানে যেমন বোলতানের ছায়া পাওয়া যেত, তেমনই ছিল ছোট ছোট সরগমের কারুকাজ। সঙ্গে উল্লেখযোগ্য স্থান পেয়েছে ‘তারানা’। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁতে জন্ম রশিদের। রামপুর-সাসওয়ান ঘরানার শিল্পী। যে ঘরানার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইনায়েত হুসেন খাঁ-সাহিব। তবে রশিদের প্রথম তালিম তার মামা গোয়ালিয়র ঘরানার উস্তাদ গুলাম মুস্তাফা খাঁ-সাহিবের থেকে। খুব অল্প বয়সে রশিদকে মুম্বাইয়ে নিয়ে যান তার মামা। সেখানে এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করান। সঙ্গে খানিক তালিমও দেন। কিন্তু সেখানে কিছু ভালো লাগেনি রশিদের। ফলে তিনি ফিরে আসেন বদায়ূঁ। বদায়ূঁতে ফিরে রশিদ তালিম নেওয়া শুরু করেন রামপুর-সাসওয়ান ঘরানার দিকপাল উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ-সাহিবের কাছ থেকে। যিনি ছিলেন সম্পর্কে রশিদের দাদু।
ছোটবেলায় আর পাঁচজন শিশুর থেকে আলাদা ছিলেন না রশিদ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ছোটবেলায় রিয়াজ করতে চাইতেন না। বেশিক্ষণ রিয়াজ করলে ‘বোর’ হয়ে যেতেন। মনে হত, গানবাজনা ছেড়ে দিই। অনেকে বলতেন, ‘‘গলা ভালো, গান করো।’’ কিন্তু তার ইচ্ছে হত না। দাদু নিসার হুসেন খাঁ-সাহিব ছিলেন কড়া প্রকৃতির মানুষ। খুব রাগী। তার সঙ্গে কথাই বলা যেত না। রিয়াজে একটু ভুলচুক হলে সোজা চড়-থাপ্পড়! মূলত তার ভয়েই রোজ নিয়ম করে রিয়াজ করতে হতো। কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যে কথা অকপটে স্বীকার করেছিলেন রশিদ।
১৯৭৮ সালে নিসার হোসেন খাঁ-সাহিব চলে আসেন কলকাতায়। সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি (এসআরএ)-র গুরু হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। সঙ্গে আসেন রশিদও। তিনি পরীক্ষা দেন এবং ‘স্কলার’ হিসাবে দাদুর কাছে শিক্ষা শুরু করেন। সে সময়ে তার পরীক্ষা নিয়েছিলেন রাইচাঁদ বড়াল, এ কানন, মালবিকা কানন, বিজয় কিচলু, ভিজি যোগ এবং দীপালি নাগের মতো ব্যক্তিত্বেরা। সেই সব দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে কুমারপ্রসাদকে বলেছেন রশিদ, প্রথম রাগ শেখা ভৈরব। কয়েক মাস শুধু ‘সা’ বলা অভ্যাস করতে বলেছিলেন দাদু। তারপর কয়েক মাস ধরে চলত খরজে রিয়াজ। অতঃপর দ্রুতলয়ে বিভিন্ন বন্দিশ শেখাতেন নিসার হোসেন। বিলম্বিত শেখা তখনও শুরু হয়নি। এসআরএ-তে আসার পর গুণী শিল্পীদের সংস্পর্শে এসে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে ভালবাসতে শেখেন রশিদ। দেশের অন্যতম সেরা শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশের পথ মোটেও সহজ ছিল না।
তাকে যে শিল্পী হতেই হবে, তার নেপথ্যে অবশ্য ছিল অন্য এক কাহিনি। এক সাক্ষাৎকারে রশিদ বলেছিলেন সেই গল্পও। একবার কলকাতার ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সে ভীমসেন জোশীর গান ছিল। রশিদ ভেবেছিলেন, খুব কাছ থেকে ভীমসেনের গান শুনবেন। মঞ্চের পাশে এক জায়গায় বসেছিলেন। সে সময় এক উদ্যোক্তা তাকে সেখান থেকে উঠে যেতে বলেন। সেই ঘটনা রশিদের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। ভেবেছিলেন, ‘‘ঠিক আছে, আমি একদিন এমন জায়গায় পৌঁছব যে, তোমাদের দৌড়তে হবে আমার পিছনে!’’ খুব অল্প দিনেই রশিদ সেই স্থান অর্জন করেছিলেন। একবার ডোভার লেন থেকে তাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য এসেছেন উদ্যোক্তারা। যেদিন ডোভার লেনে অনুষ্ঠান, তার আগেই প্যারিসে রশিদের অনুষ্ঠান। রশিদ সেই অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে উদ্যোক্তাদের বলেছিলেন, ‘‘আপনারা যদি প্যারিস থেকে আমাকে উড়িয়ে আনতে পারেন, তা হলে আমি আপনাদের অনুষ্ঠানে গাইব।’’
রশিদের নিজের ঘরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ‘বোলতান’। যা রশিদের গায়কিতে শেষ দিন পর্যন্ত ধরা দিত। সেই সঙ্গে ছোট ছোট সরগম করে বন্দিশের মুখড়াতে ফেরার যে শৈলী, তা-ও রপ্ত করেছিলেন। ফলে তার গানে যেমন নিসার হোসেন খাঁ-সাহিবের বোলতানের ছায়া পাওয়া যেত, তেমনই ছোট ছোট সরগমের কারুকাজ করে স্বকীয় ছাপ আনার চেষ্টা করতেন তিনি। সেই সঙ্গে তার গানে উল্লেখযোগ্য স্থান পেয়েছে ‘তারানা’। যা তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। কারণ, উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ-সাহিব তারানা গায়নকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কী ভাবে রিয়াজ করা উচিত, সে সম্পর্কে রশিদের ধারণা পরবর্তী কালে অবশ্য খানিক বদলেছিল। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, চল্লিশ দিনের ‘চিল্লা’, বারো ঘণ্টার রিয়াজে তিনি বিশ্বাস করেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিল্পীদের প্রতি ঈশ্বরের ইঙ্গিত থাকে। তার জোরেই তার মতো শিল্পীরা গানবাজনা করেন। ফলে রশিদ শুধু রামপুর-সাসওয়ান ঘরানার শিক্ষাতেই আবদ্ধ রাখেননি নিজেকে। অন্য সব ঘরানার বিখ্যাত শিল্পীদের ভালোটাও নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, ‘‘আমার গুরু উস্তাদ নিসার হুসেন সব সময় বলতেন, আর যা-ই করো, ভুলেও কাউকে কোনো দিন হিংসা কোরো না। হিংসা করলে সঙ্গীতের মৃত্যু অনিবার্য। সাধনা করতে করতেই নিজস্ব গায়কি তৈরি হয়। সঙ্গীত ‘দিল আর দিমাগ’-এর কাজ। ওখান থেকেই একটা ‘সোচ’-এর জন্ম হয়। ওই ‘সোচ’ই আমায় দিয়ে নানা রকম কাজ করিয়ে নেয়।’’
জীবনের প্রথম অনুষ্ঠান কলকাতাতেই। ১০-১১ বছর বয়সে। যেখানে রশিদের গানের পর পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাজনা ছিল। যে অনুষ্ঠানের কথা পরবর্তী কালে বহুবার স্মরণ করেছেন রশিদ। বলতেন, ‘‘জীবনে প্রথম বার সামনে পাঁচ-ছ’হাজার লোক দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। সেই অনুষ্ঠানে অনেক গুণী মানুষ এসেছিলেন। আমি পটদীপ গেয়েছিলাম। মানুষের খুব ভালো লেগেছিল।’’
পণ্ডিত ভীমসেন জোশীর সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছিল রশিদের। পুনেতে রশিদের অনুষ্ঠান থাকলে ভীমসেন উপস্থিত থাকতেনই। পুনেতে রশিদ আসছেন শুনলে এক ‘কমন ফ্রেন্ড’কে নির্দেশ দিতেন রশিদকে তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তেমনই একবার গিয়েছেন সন্ধ্যার পর। ভীমসেনের বাড়িতে আট-দশ জন শ্রোতা এসেছেন। রশিদ গান করেছেন। গানের পর রশিদকে ১০ হাজার রুপি ‘নজরানা’ দেন ভীমসেন। রশিদ তো কিছুতেই নেবেন না। ভীমসেন বলেছিলেন, ‘‘কখনওই নজরানা ছাড়া গান গাইবে না!’’
মূলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গাইলেও ফিউশন, বলিউড এবং টলিউডের ছবিতে বহু গান করেছেন রশিদ। তার মধ্যে ‘যব উই মেট’-এর ‘আওগে যব তুম ওহ্ সাজনা’ অসাধারণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
গজলের অ্যালবাম করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন। তার কণ্ঠে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির ঠুংরি ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ শুনতে চেয়ে অনুরোধ আসত শ্রোতাদের।
সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, পদ্মশ্রী সম্মান যেমন পেয়েছেন, তেমনই বাংলা থেকেও পেয়েছেন বঙ্গবিভূষণ সম্মাননা। বাংলাকে ভালবেসে যিনি কলকাতায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেই বাংলার মাটিতেই বিদায় নিলেন রশিদ। ক্যানসার এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জোড়া থাবা এড়িয়ে আর সমে ফেরা হলো না তার।
শিল্পীর প্রয়াণ হয়। কিন্তু শিল্পের তো হয় না। ফলে দেশবিদেশের অজস্র ভক্তের কাছে অনুরণিত হবে, হতেই থাকবে ‘ভূমণ্ডলের দীপ্যতম সুরগন্ধর্ব’-র ‘ঐশ্বরিক’ কণ্ঠ।