বহুমাত্রিক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ (জন্ম: ৩ আগস্ট ১৯৪৩; মৃত্যু: ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০)। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। নানা প্রসঙ্গ এলেই সঙ্গতভাবে তিনিও আসবেন। সাহিত্যের জন্য তিনি চাকরির পদমর্যাদা, উচ্চশিক্ষার সনদও তুচ্ছজ্ঞান করেছেন। তার ক্ষেত্রে, তিনি জীবনকে সাহিত্যের সাথে, না সাহিত্যকে জীবনের সাথে একাকার করেছেন - তা খণ্ডন করা কঠিন। তিনি সাহিত্যকে জীবনের সমান্তরালে জীবনের মতোই ভীষণ গুরুত্ব দিতেন।
কেউ তাকে বলে শক্তিমান কবি, কেউ বলে সব্যসাচী লেখক, কেউ বা বলে ‘সকল প্রশংসা তাঁর’-এর কবি। যেভাবেই যে বলুক না কেন, তার আত্মমগ্নতা ছিল সাহিত্যের প্রতি, সাহিত্যকেন্দ্রিক। তিনি কবি হিসেবে খ্যাতিমান, গবেষক হিসেবে খ্যাতিমান, প্রাবন্ধিক হিসেবে খ্যাতিমান। সম্পদানার দিক দিয়ে তিনি অতি উচ্চে- যেখানে পৌঁছানো কঠিন। কথাসাহিত্যে তার কলম নির্ভীক উড়ন্ত পাখির মতো। এটা সাহিত্যের অন্য ভুবনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কবিতায় তার ভাঙা-গড়ার খেলা সততই আলোচনায় উঠে আসে। প্রবন্ধ, গবেষণা, সম্পাদনার মতো বিষয়ের কোনো কোনো দিকে তিনি প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বলা যায়, তিনি নিজেই ছিলেন এক সাহিত্য ভাণ্ডার। সাহিত্য নিয়ে তার আত্মঅহংকার ছিল সংশয়হীন, নির্ভেজাল। তিনি ছিলেন শুদ্ধতম লেখক, সাহিত্যিক।
আবদুল মান্নান সৈয়দের গ্রন্থ সংখ্যা কত, বলা মুশকিল। তবে দেড় শতাধিক গ্রন্থ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যের শাখাগুলো তার বিচরণে কৃতার্থ বা গর্বিত - যাই বলি না কেন, বর্তমান সময়ে তার মতো এতো স্বতঃস্ফূর্ত বহুমাত্রিক বিচরণশীল লেখক আর কই, যেমনটি তিনি থাকতে একাই ছিলেন। তিনি কবিতা লিখছেন, গল্প লিখছেন। উপন্যাস লিখে চলছেন সমানে। সম্পাদনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন দুই হাতে। যেখানেই তাকানো যাবে, তাকে পাওয়া যাবে। সাহিত্যের আড্ডায়, বইয়ের লাইব্রেরিগুলোতে, পত্রিকার অফিসে। হোটেলেও তাকে পাওয়া যায় সদা হাস্যোজ্জ্বল আর প্রাণবন্ত আড্ডায়। ‘উজ্জল হোটেল’ তো তার উপস্থিতির জন্য উজ্জ্বল হয়ে আছে।
তার এই রকম বিচরণ সুন্দরের জন্য, সাহিত্যের জন্য। ব্যক্তির রুচির সাথে তার আড্ডার রুচির দারুণ একটা মিল আছে। জীবন ও সাহিত্য - দুটো ক্ষেত্রেই রুচিশীলতার একটি মিশেল বেশ চোখে পড়ার মতো।
এতো আড্ডা আর আড্ডায় এতো সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, তারপরও অবাক লাগে নিয়মিত তার লেখা বের হচ্ছে। নানা জায়গা থেকে বের হচ্ছে, নানা বিষয়ে। তিনি লিখছেন কখন? তিনি বসলেই লিখতে পারতেন। এক সিটিংয়েই লেখা। তার বসাটাই আসলে আসল। পুরা সাহিত্য বিষয়ক খুুঁটিনাটি থেকে বিষয়ের পর বিষয় তার যে নখদর্পণে।
সোজাসাপ্টা ভাষায়, তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন - পড়াশুনায়, লেখালেখিতে, আড্ডায়। বক্তৃতায় তাকে পাওয়া যেত। টিভি’র পর্দায়ও তাকে দেখা যেত। এমনকি তিনি আড্ডাও দিচ্ছেন, লেখাও চালিয়ে যাচ্ছেন। আড্ডা শেষ হওয়ার সাথে সাথে একটি পূর্ণাঙ্গ লেখাও বেরিয়ে আসছে তার হাত থেকে। এমনটাও দেখা যেত। সাহিত্য, আড্ডায় কে যে কার আনন্দ বোঝাই মুশকিল ছিল। সবকিছুতে প্রাণ ছিল। তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত।
তিনি লিখতেন নিজস্ব ঢঙে। তার বানানরীতির কিছু ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। শব্দ চয়নের সাথে সাথে হাইফেন (-), ড্যাশ (-), কমার (,) মতো বিষয় ব্যবহারে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। কথা বলতেন স্পষ্ট করে, বক্তৃতাতেও। বক্তৃতার স্বরধ্বনি ছিল সমান্তরাল, তেজদীপ্ত, উচ্চারণে বলিষ্ঠ। কথায় দৃঢ়তার ছাপ ছিল। ভঙ্গিমায় কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। ছন্দ সচেতন ছিলেন। তার জীবনযাপন ছিল সাহিত্যের মতো আলংকারিক ও ছন্দবদ্ধ। সাহিত্যের সৌন্দর্যের প্রতি সচেতনতা হয়ত তাকে জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও, চলনে বলনে, আচরণে ছন্দবদ্ধতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তবে বেহিসেবি আড্ডা তার প্রিয় ছিল। আড্ডায় ছিল প্রাণের স্পর্শ, ছন্দের দোলা।
তবে সব কিছুতেই তিনি রুচিশীল - পোশাকে-আশাকে, শালীনতায়, আচারে-ব্যবহারে। লেখায়, সম্পাদনায়ও। এমনকি বলাতেও তার রুচির প্রকাশ উপচে পড়ত যেন। প্রকাশের ক্ষেত্রে নিজস্ব রুচির ধরনটা ফুটে উঠত, স্পষ্ট বোঝা যেত। যে কেউ, উপস্থিতিদের মধ্যে, তা বুঝতে পারত। তার প্রকাশভঙ্গি ছিল নিজস্ব। সবখানে আন্তরিকতা দেখাতেন। অভিনয়ও করেছিলেন আন্তরিকতার সাথে।
তিনি সাহিত্য সংক্রান্ত পত্রিকা অসম্ভব ভালোবাসতেন। যে কেউ করলে, তরুণ হলে তো কথাই নাই, ভীষণ উৎসাহ দিতেন। আগ্রহ দেখাতেন। তরুণটি যদি ‘বেয়াদপ (!)’ নয়, অন্তত এটুকু বুঝতে পারতেন, তাহলেই ওই তরুণটি সহজে তার স্নেহভাজন হতে পারত। পত্রিকা প্রকাশের কথা বললে তিনি ঝুঁকে পড়তেন। আত্মমর্যাদার ভিতর যে বন্ধুবৎসল প্রকৃতির চমৎকার মিশেল তা খুব কাছে গেলেই উপলব্ধি করা যায়। যেমন সম্মান চান, ভালোবাসা দেন তার চেয়ে বেশি উদারভাবে। তার ওই হো হো করে হেসে ওঠা অট্টহাসিগুলো সব ব্যবধান মুছে দিত।
পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, করা পছন্দও করতেন। সাহিত্য সংক্রান্ত পত্রিকার প্রতি তার ঝোঁক ছিল অসম্ভব রকম। বের করেছিলেন ‘শব্দশিল্প’ পত্রিকা। একটি সংখ্যা বের হয়েছিল। মাত্র চারটি সংখ্যা বেরিয়েছিল ‘চারিত্র’ নামে তার সবচেয়ে প্রিয় পত্রিকাটি। করার ইচ্ছাও ছিল আরো অনেক। একটার পর একটা নাম দিয়ে নতুন নতুন পত্রিকার কথাও তিনি একদিন বলেছিলেন। তবে তার আশা পূর্ণ হয়নি। প্রিয় ‘চারিত্র’র আর কোনো সংখ্যা হয়নি।
আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন, “মনমতো একটি পত্রিকা সম্পাদনার সাধ আমার অপূর্ণই রয়ে গেছে আজো। সুযোগ পেলে করে ফেলব একদিন”। তার এই সাধ আর পূরণ করার সময় তিনি পাননি। সত্যি, অপূর্ণই রয়ে গেছে। তার জন্য আরেকটি বিষয় অপূর্ণ রয়ে গেছে, আমার মতোই। সেটা আমারই সাথে জড়িত। আমিও একদিন তাকে বলেছিলাম, “আপনার উপর একটি সংখ্যা করব।” ব্যক্তিগতভাবে তার স্নেহভাজন হওয়ায় সংখ্যা করার কথায় তিনি আমার উপর খুশিই হয়েছিলেন। সাহিত্যের বিচরণভূমিতে আমার পদচারণা, উপস্থিত, কাজ - সবই তিনি জানতেন বিধায় আশাবাদীও হয়েছিলেন। বলেছিলেন, “কর”। দারুণ সম্মতি ছিল ওই ‘কর’ শব্দটির মধ্যে। ওই সম্মতির সাথে মিশে ছিল ভালোবাসা, স্নেহ, প্রীতি - সবই। তখন তিনি তার নিজে, তার উপর একজন কাজ করার জন্য অনেক কিছু নিয়েছিল বলে জানালেন। আমিও জানতাম অনেক আগেই, কেউ একজন তার উপর কাজ করছে। তাই এতদিন মনের ইচ্ছাটা প্রকাশ করিনি। যখন দেখলাম সেরকম আর নিকট ভবিষ্যতে সম্ভাবনা নাই, তখন আমার আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছিলাম। বলেছিলেন, “কিভাবে করতে চাও, কি কি লাগবে বলো।” ঘটনাচক্রে সেখানে আরো কেউ কেউ সে সময় উপস্থিত ছিল। আরো বলেছিলেন, “তুমি করলে তো ভালোই হয়।”
সংখ্যা প্রকাশের সাধ আমারও অপূর্ণই রয়ে গেছে আজো। তবে তার মতো সুযোগ পেলে করে ফেলার ইচ্ছা আর নাই। হয়ত অপূর্ণই রয়ে যাবে। কেননা আমার বরাবর ইচ্ছা কারোর জীবদ্দশায় ‘এই জাতীয়’ কিছু করার। করে তাকে দেখানোর মতো সেই সুযোগ আর হলো না।